সুন্দরবনে আরও পর্যটনকেন্দ্র

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়া জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় না, দেশের সার্বিক উন্নয়নও ঘটে না। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর মধ্য দিয়ে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা অবিরাম চালিয়ে যেতে হয়। তবে যেকোনো উপায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনই যদি প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়, তাহলে যে কিছু গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা এখন সারা বিশ্বের মানুষই কমবেশি উপলব্ধি করতে পারছে।

সমস্যা হলো, মানুষের কিছু কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। এটা শুধু পরিবেশবাদীদের কথা নয়, এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম নর্ডহাউস বলছেন, লাগামহীন প্রবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় লিপ্ত মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতি অবিরামভাবে চলতে থাকলে একটা পর্যায়ে খোদ প্রবৃদ্ধিই ব্যাহত হবে। এটাকে তিনি এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলে সতর্ক করছেন। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে বিবেচ্য, কারণ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে উচ্চ হারে, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ যে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে দিকে আমাদের তেমন দৃষ্টি নেই। আমরা শিল্প–উৎপাদনসহ নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি, সেসবের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন থেকে। পর্যটনশিল্পও একধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সেখানে ইতিমধ্যে সাতটি পর্যটনকেন্দ্র আছে, উপরন্তু সোমবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, বন বিভাগ সুন্দরবনে আরও চারটি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। এ জন্য বন বিভাগ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

বন বিভাগ এই প্রস্তাব করেছে সুন্দরবনে পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান ভিড় সামলানোর উদ্দেশ্যে। আমাদের বিবেচনায় এটি একটি ক্ষতিকর প্রস্তাব, কেননা সুন্দরবনের পরিবেশ ইতিমধ্যেই নানা ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ফলে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বনে পর্যটকের ভিড় আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়, বরং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ইকো ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন বলে যে ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে, ইতিমধ্যে বিপন্ন সুন্দরবনের ক্ষেত্রে তার প্রসার আরও ক্ষতিকর হবে। বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলো আরও চারটি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে অর্থনৈতিক লাভের কথা ভেবে, কিন্তু এর ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য থেকে শুরু করে সামগ্রিক পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, সে কথা তারা ভাবছে না।

কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন বিভাগের এমন প্রস্তাব করা উচিত হয়নি বলে আমরা মনে করি। বরং ইতিমধ্যে যেসব পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর সুব্যবস্থাপনা ও সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি পর্যটন কার্যক্রমকে সুন্দরবনের জন্য সর্বাধিক পরিবেশবান্ধব করার দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি কাজ। বিশেষভাবে প্রয়োজন সুন্দরবনের প্রধান বন্য প্রাণীগুলোর প্রজনন মৌসুমে পর্যটন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা।