ইলিশ নিষিদ্ধ: কার জন্য ও কেন?

বাংলাদেশে ইলিশের পরিমাণ (উৎপাদন নয়) বেড়েছে, এটা গড় অনুমান মাত্র। ইংরেজিতে বলে হাইপোথিসিস। ইলিশের পরিমাণ যা-ই হোক, এর পেটে ছয় মাস ডিম থাকে, এটা আমাদের জানা কথা। একসময় উত্তরবঙ্গের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ অন্য নদ-নদীতে সারা বছর ইলিশ ধরা পড়ত, এখন তা অতীত মাত্র। তবু আমাদের পত্রিকায় পড়তে হয়, ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের জেলে-কৃষকেরা ইলিশ খেতে পান না কয়েক দশক ধরে, তবু ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে! দক্ষিণবঙ্গে পদ্মা-মেঘনায় যে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, সেই কয় দিন ইলিশ উত্তরবঙ্গের নদ-নদীগুলোয় পাওয়া যায়। দুই-তিন বছর ধরে উত্তরেও এই ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আর তা করতে গিয়ে মাছ ধরাও একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর যেসব এলাকায় সারা বছর ইলিশ ধরা পড়ে, সেই এলাকার মতো উত্তরের জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তাও নেই। কিন্তু জেল-জরিমানা আছে। মানে কিল আছে, তবে ভাত নেই।

৭ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউনে ‘ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ হলেও খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন না কুড়িগ্রামের জেলেরা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষা এবং ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই সোমবার (৭ অক্টোবর) থেকে কুড়িগ্রামসহ দেশের ৩৭ জেলার নদ-নদীতে ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই সময় জেলেদের সরকার থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। তবে কুড়িগ্রামের প্রায় ১৮ হাজার জেলের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রথমবারের মতো ইলিশ জোন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কুড়িগ্রামের নদ-নদীতে মা ইলিশ শিকার বন্ধ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসকের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের জেলেদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষ বরাদ্দের (ভিজিএফ) নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’

ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু হানিফা বলেন, ‘গত বছর এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে। সে জন্য এ বছরও আমার ইউনিয়নের জেলেরা ইলিশ শিকারের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। পেশাদার জেলেদের পাশাপাশি অপেশাদার জেলেরাও ইলিশ শিকারের জন্য জাল ও নৌকা প্রস্তুত করছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদে তারা ইলিশ ধরতে নামবে।’

২.
কুড়িটির অধিক নদ-নদীময় জেলা কুড়িগ্রাম। কিন্তু সবচেয়ে কম মাছ খেতে পায় কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। আয়োডিনের ঘাটতির কথা তো দেশময় ছড়ানো। গবেষণা প্রতিবেদনগুলো জানাচ্ছে, কুড়িগ্রাম জেলার শিশুরা অস্বাভাবিক হারে বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। সবাই স্বীকার করবেন, ইলিশের সঙ্গে এই ঘটনার যোগ আছে। মুক্তিযুদ্ধসহ কৈবর্ত বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কালে আমরা বুঝেছি, জনগণের কাছে মর্যাদাটুকু খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময়ও রংপুরের কোথাও কোথাও বাইরের সাহায্য ছাড়াই স্বনির্ভর গ্রাম মানুষ গড়ে তুলেছিলেন। তেমনিভাবে খাদ্য সহায়তা নিতে গেলে যে পরিমাণে নেতাদের হাতে-পায়ে ধরতে হয়, এতে জেলে-কৃষকেরা অপমানিত বোধ করেন। চিলমারী উপজেলার ঝালোপাড়ার জেলে কোকিল চন্দ্র (৫০) বলেন, ‘এই কয়টা দিন হামরা ইলিশের মুখ দেখি, তাও সরকার বন্ধ করি দিছে। কিন্তু হামরা না মাইরনো ঠিক আছে, কিন্তু ইলিশ যে আসাম চলি যাচ্ছে, সেটা ঠেকায় কেডা?’

আমরাও গত বছর পত্রপত্রিকায় কোকিল চন্দ্রের কথার সত্যতা পেয়েছি। আসামের হাটে-বাজারে ১০০ টাকা কেজিতে ইলিশ পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেই কুড়িগ্রামের জেলে-কৃষকেরা যদি সীমান্তে ইলিশ ধরতে আইনগত বাধা পান, তাহলে ইলিশের আসামযাত্রা ঠেকানোর পথ কোথায়? ইলিশকে আমরা কত দূর উজানে যেতে দেব, সেটা গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই। আর এই কয় দিন আসামিরা (অসমীয়) যে ব্যাপক হারে ইলিশ শিকার করে, তা দিয়ে তাদের চাহিদার বড় অংশই পূরণ হয়। এটা নিশ্চয়ই আমাদের ইলিশ রপ্তানির জন্য সুখবর নয়। আল্লাহ মালুম, ফারাক্কা অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গেও ইলিশ যায় কি না!

৩.
ইলিশ নিষিদ্ধের এই ২২ দিন বাংলা আশ্বিন-কার্তিক মাসেই হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের মঙ্গা বলে একটা ব্যাপার উত্তরবঙ্গে চালু আছে। এই সময় কর্মসংস্থানের অভাবে ক্ষুদ্র চাষি ও কৃষিশ্রমিকেরা কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যান। কার্তিকের এই মঙ্গার কালে নিবন্ধিত ১৭ হাজার ৬৪৩টি জেলে পরিবারের ৮৫ হাজার মানুষ কোন নদীতে যাবেন?

কী এক অদ্ভুত রাষ্ট্র! জালুয়া-তাঁতির পূর্বপুরুষেরা রক্ত দিয়ে বানিয়ে দিয়ে গেছেন এই দেশ। যে জেলাগুলোয় শিক্ষা নেই, কর্মসংস্থান নেই, দারিদ্র্যের শীর্ষে যাদের অবস্থান, সেখানে প্রকৃতি ও ভূগোল তাদের যা দিয়েছে, রাষ্ট্র আইন বানিয়ে তাও কেড়ে নেয়! জনগণের রুটি-রুজি নিয়ে যে আইন তৈরি হবে, তা বানাতে তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও সম্মতি ছাড়া যে আইন, সে আইন কি মান্য হতে পারে? যে আইন জনগণের বোঝাপড়া ও সম্মতিতে তৈরি হয়, তাই-ই কেবল জনগণ স্বেচ্ছায় পালনে ও প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের আইন কি উত্তরবঙ্গের জেলেদের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল? বছরের বাকি দিনগুলোয় যদি ইলিশ পাতে না জোটে, নিষিদ্ধের ২২ দিন যদি খাদ্য না জোটে, তাহলে অক্টোবরের ১৭ তারিখ যে চিলমারীবাসী পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করার জানবাজি রাখা যুদ্ধ করেছিল, সেই যুদ্ধ কি নিজের সর্বনাশ করার জন্য ছিল? এই দ্যাশটা কার বাহে?

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]