নির্বাচনী সংলাপ

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার পর তাঁর পক্ষ থেকে দ্রুত ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সংলাপের দিনক্ষণও ঠিক হয়েছে। সংলাপের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপ হতে যাচ্ছে, এটি একটি সুখবর। শেষ কবে সংলাপ হয়েছিল, জনগণ তা ভুলতে বসেছিল। সারা দেশে স্বস্তির বাতাস বইবে, যদি এই সংলাপ ফলপ্রসূ হয়। আগামী সাধারণ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাক্‌-নির্বাচনী পরিবেশ কী রূপ নেয়, তার ওপর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি অনেকটা নির্ভর করছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগকে কার্যত স্বীকার করতে হয়েছিল যে তারা এ রকম আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চায় না। একতরফা নির্বাচন সত্ত্বেও সরকার ও সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তি একদিকে ক্ষমতাসীনদের সাফল্য; অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হবে। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে তারা পাঁচ বছরের মেয়াদ পার করতে পেরেছে; কিন্তু এতে গণ-আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের গৌরব বেড়েছে—এমন কথা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী দল সম্পর্কে যত নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করুন না কেন, সংলাপে বসতে আগ্রহ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁরা এই ইঙ্গিতই দিতে চাইছেন যে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হোক।

অন্যদিকে ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন যে ভুল ছিল, সেই উপলব্ধিও দলটির নেতৃত্বের মধ্যে এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়। ধারণা করা যায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির শামিল হওয়ার উদ্দেশ্য আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধানসম্মত যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাত দফা প্রস্তাব করা হয়েছে। আলোচনায় উভয় পক্ষ পরস্পরের যুক্তি তুলে ধরবে, অপর পক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য যদি হয় একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন; তাহলে সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। আন্তরিকভাবে সেটা চাইলে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হতে পারে। নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমরা চাই সংলাপ সফল ও ফলপ্রসূ হোক।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার হাতবদলের একমাত্র সংবিধানসম্মত পন্থা হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক। সে রকম নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। আন্তরিক ও ফলপ্রসূ সংলাপের মধ্য দিয়ে সবার সহযোগিতায় সেই পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে—এটা মনে রেখেই সংলাপে বসা উচিত।

সরকার ও সংসদ পরিচালনা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম বোঝাপড়া প্রয়োজন। অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা নিশ্চিত করতে পারেনি বলে রাজনীতি সংঘাতের দিকে গেছে। আশা করব, বর্তমান নেতৃত্ব সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। সংলাপ লক্ষ্যাভিমুখী হওয়া উচিত, সেখানে আলাপ–আলোচনা নির্বাচনকে ঘিরেই হওয়া উচিত। অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সব প্রার্থী ও দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাসহ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন বিষয়ের উত্থাপন না করাই ভালো হবে।

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সাধারণভাবে যে একধরনের অস্বস্তি বা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই তার অবসান হওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, সংলাপ সেই সুযোগ সামনে এনেছে।