মনে বাজে ভূপেন হাজারিকা

শিল্পী ভূপেন হাজারিকা
শিল্পী ভূপেন হাজারিকা

আজ ৫ নভেম্বর। বাংলা ভাষার গণসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণদিবস। বাংলা ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং এই বাংলাদেশে এমন কোনো শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যাবে না, যিনি শিল্পী ভূপেন হাজারিকার নাম শোনেননি। তাঁর ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের প্রথম ১০টি জনপ্রিয় গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। শেষ জীবনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অনেক আলোচনা–সমালোচনাও হয়েছিল। মৃত্যুর পরেও ভূপেন হাজারিকার গান মানুষকে আগের মতোই মুগ্ধ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলাম বলে প্রায়ই ধ্রুপদি ধারার গানের মতো গণসংগীত শোনা হতো। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী ও ভূপেন হাজারিকাই সবচেয়ে বেশি শোনা হতো। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের সঙ্গে যে বয়ান বা গল্পগুলো থাকত, তার মাধ্যমেই ভারতবর্ষের বাইরের অনেক গণসংগীতশিল্পীকে চিনতে পেরেছিলাম। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছেই পল রোবসন, বব ডিলান ও পিট সিগারের কথা শুনেছিলাম। এই তিনজনের গানের মধ্যে কেন জানি আমার একটু বেশি সহজবোধ্য মনে হতো ভূপেন হাজারিকাকে। সুরের দিক থেকে বিচার করলে অত্যন্ত সুরেলা ছিল তাঁর কণ্ঠ। যেসব গান নিয়মিত শোনা হতো, তার মধ্যে ‘শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘বিস্তীর্ণ দুপায়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার’, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘দোলা হে দোলা’, ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’।

ভূপেন ছোটবেলা থেকেই আনন্দীরাম দাস, পার্বতী প্রসাদ বড়ুয়া ও কমলানন্দ ভট্টাচার্য নামের তিনজন গীতিকারের মাধ্যমে স্থানীয় বরগীত, গোয়ালপাড়ার গান, চা–মজদুরের গান, বিহুগীতসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ সংস্কৃতির রস আস্বাদন করেন। অসমিয়া সংগীতের পুরোধা এই ওস্তাদেরাই প্রাথমিকভাবে তাঁকে প্রভাবিত করেন। পরবর্তী সময়ে জ্যোতিপ্রসাদ নামের একজন সংস্কৃতির সুধাসাধক ও শিল্পমোদী, যিনি একাধারে সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক-থিয়েটার প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর প্রভাব ভূপেন হাজারিকার জীবনে পড়েছিল। জ্যোতিপ্রসাদের মতো হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরেই সংগীতের জগতে ভূপেন হাজারিকার পা পড়ে। তিনি ছোটবেলা থেকেই সর্বভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারা-উপধারার মতো গণসংগীত বুঝতে শেখেন। কাজী নজরুল ইসলাম, মুকুন্দ দাস থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশের বহু নামীদামি লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী, বিশেষ করে সত্যেন সেন, শচীন দেববর্মন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকের সঙ্গে সখ্য ছিল। এ কারণে তাঁর গানের ওপর তাঁদের প্রভাবও ব্যাপকভাবে ছিল বলে আমি মনে করি।

ভূপেন হাজারিকার মার্ক্সবাদী জীবন–দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পাশাপাশি গানের ওপর প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে বিদেশি সংগীতজ্ঞের প্রণোদনাও ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। বিশেষ করে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় তাঁর ক্যাম্পাসে তখনকার সময়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি, লেখক, সংগীতশিল্পী, নিগ্রো আন্দোলনের নেতা ও অ্যাকটিভিস্ট গণসংগীতশিল্পী পল রোবসন কনসার্ট করতে আসেন। সেখান থেকেই ‘ও মিসিসিপি’ গানটি শুনে তিনি একেবারে পল রোবসনের ভক্ত হয়ে ওঠেন। পল রোবসনের প্রভাবেই পরবর্তী সময়ে তিনি ‘বিস্তীর্ণ দুপায়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার’ গানটি রচনা করেছিলেন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনার্ত আবেগের এই গান। আমি মনে করি, এই গানের মৌলিকত্ব, সংগীতীয় আবেগ ও দ্যোতনা কোনোভাবেই পল রোবসনের গানের চেয়ে কম নয়। পল রোবসনের পাশাপাশি ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরুদ্ধ ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আমেরিকার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বলে খ্যাত বব ডিলান, পিট সিগার দ্বারাও তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। একইভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হয়ে দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ অন্য অনেকের প্রভাবে মানবতাবাদী, জীবনমুখী গান রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

ভূপেন হাজারিকার গান বাণী ও বিষয়বৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুমুখী। তিনি আজীবন মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মানবপ্রেমই তাঁর গানের মূলকথা। তাঁর গানের মধ্যে মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বহিঃপ্রকাশ চিরায়ত। বিশেষ করে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়’ ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’ গানগুলো মানুষের মধ্যে জাত-পাতে, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার ডাক দেয়। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মতো প্রেম নিয়েও অনেক গান দেখতে পাই। এই যেমন ‘সহস্রজনে মোর প্রশ্ন করে’, ‘মাইয়া ভুল বুঝিস না, ও মাইয়া ভুল বুঝিস না’, ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার, মৌনতার সুতোয় বোনা’ গানগুলো মানুষকে আবেগপ্রবণ জীবনের দিকে পথনির্দেশ করে।

গোলপাড়িয়ার গানগুলোর কথা, বিশেষ করে প্রতিমা পান্ডের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে যে গানগুলো গেয়েছেন, তা ভূপেন হাজারিকার অমর সৃষ্টি। আমি এখনো যখন প্রতিমা পান্ডের সঙ্গে ‘মোর মাহুত বন্ধু রে’ গানটি শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। মানবতাবাদ, প্রেম, প্রকৃতি, লোকগানের পাশাপাশি তাঁর গানে আশাবাদিতার একটি ছাপ থাকে। তিনি যখন তাঁর গানে বলে ওঠেন ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়, মরণ ভুলে গিয়ে ছুটে ছুটে আয়’, তখন মানুষ হতাশার, স্বপ্নভঙ্গের রূঢ় বাস্তবতার বাইরে বেঁচে থাকার অপ্রতিরোধ্য স্বপ্ন না দেখে বাঁচতে পারে না। এটাই তাঁর গানের অন্তর্নিহিত শক্তি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধ এবং এই অঞ্চলের মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য কনসার্ট করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও জোয়ান বায়েজের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। কিন্তু সরাসরি রণাঙ্গনের যোদ্ধা এবং বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য তাঁর ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘দোলা হে দোলা’, ‘বিস্তীর্ণ দুপায়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার’ গানগুলো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, পরবর্তীকালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও মানবিক সংকটে যুবক, তরুণদের নিত্যদিনের খোরাক এই গানগুলো। শুধু তা–ই নয়, আসামে জন্ম হলেও বাংলাদেশের প্রতি ভূপেন হাজারিকার প্রতি মায়া, ভালোবাসা ও আবেগ সব সময়ই একটু বেশি ছিল বলে তাঁর সারা জীবনের সঙ্গি কল্পনা লাজমির জবানবন্দি থেকে উঠে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বহুজনকে বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন উপাধি, পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করলেও ভূপেন হাজারিকাকে এখনো কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়ার রীতিও প্রচলিত আছে। ভবিষ্যতে এটা হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শিল্প–সংস্কৃতির বলয়ের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের সঙ্গেও এ বাংলার মানুষের হৃদ্যতা বাড়ত বলেই আমি মনে করি।

জীবনের শেষ মুহূর্তে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান, কল্পনা লাজমির সঙ্গে প্রথাবিরোধী সাংসারিক জীবন, এমনকি ভূপেন হাজারিকার গানে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত মানবতাবাদী ঝোঁক নিয়ে সমালোচনা আছে। এসব সমালোচনার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সত্যতা থাকলেও আমি মনে করি, তাঁর গান আমাদের সংগীতাকাশের নক্ষত্র। আজকের দিনে আমাদের তাই ভূপেন হাজারিকাকে বড় বেশি প্রয়োজন। বিনম্র শ্রদ্ধা ভূপেন হাজারিকা।

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।