বাঙালি খুন আসামে, লাভ মমতার

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়ে দাঁড়িয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখ্য কান্ডারি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়ে দাঁড়িয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখ্য কান্ডারি।

জাতিবাদী রাজনীতির ওজনদার দিক হলো এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সীমানা মানে না। আসামের তিনসুকিয়ায় গত বৃহস্পতিবার পাঁচ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার ধারণাতীত প্রতিক্রিয়া পড়েছে কলকাতার রাজনীতিতে। অথচ আপার আসামের তিনসুকিয়া জেলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যাতায়াত দূরত্ব প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার।

জাতিবাদী রাজনীতির আরেক বিপদের দিক—এটা অনেক সময়ই উদ্যোক্তাদের জন্য বন্য পরিণতি ডেকে আনে। তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ড আসাম-ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গজুড়ে প্রবল বাঙালি–আবেগের ঢেউ তুলেছে, যা ভয়ের কারণ ঘটিয়েছে বিজেপির জন্য। অথচ ভারতে জাতিবিদ্বেষের রাজনীতিতে এত দিন তারাই চ্যাম্পিয়ন শক্তি।

নির্বাচনের মৌসুমে নমশূদ্রের রক্তে বিপদে বিজেপি
আর কয়েক মাস পরই ভারতে লোকসভার নির্বাচন। কেবল খুনোখুনি নয়, রাজনৈতিক পরিসরের প্রতিটি নিশ্বাসও এখন নির্বাচনী হিসাব ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফলে, বিজেপি–শাসিত আসামের তিনসুকিয়ায় পাঁচ বাঙালি নমশূদ্রের রক্ত কয়েকটি রাজ্যজুড়ে বিজেপির নির্বাচনী হিসাবে গোলমাল তৈরি করেছে।

আসামে লোকসভার আসন ১৪টি এবং পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি। বিজেপির দখলে আসামে আছে ৭টি এবং পশ্চিমবঙ্গে ২টি। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে বিজেপি আসামে ১১টি এবং পশ্চিমবঙ্গে ২২টি আসন পেতে চায়। অর্থাৎ, আসামে বাড়াতে চায় ৪টি আর পশ্চিমবঙ্গে ২০টি। এই হিসাবে বিজেপির জন্য আসামের চেয়েও লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মাঠ কলকাতা। কিন্তু আসামে জাতি ও ধর্মবিদ্বেষের রাজনীতিতে অতিরিক্ত তাপ ছড়াতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিপদে পড়ে গেছে আরএসএস-বিজেপি পরিবার।

১ নভেম্বর আসামে যাঁদের মারা হলো, তাঁরা সবাই হিন্দু বাঙালি। উপরন্তু, তাঁরা সবাই নমশূদ্র। বাঙালি নমশূদ্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রভাবশালী এক ভোটব্যাংক। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে এই ভোটব্যাংকে তৃণমূলের আধিপত্যে ফাটল ধরাতে চাইছে। কিন্তু তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে মমতার তৃণমূল এটাকে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে আবেগময় ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে। ঘটনার পরপরই পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক-সাংসদদের একটা দল পাঠিয়েছে তিনসুকিয়ায়। এতে নিজেদের তাঁরা বাঙালিত্বের আশ্রয় এবং বিজেপিকে বাঙালিবিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে কিছুটা সফল। এর ফলে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির লোকসভা ভোটের হিসাবে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো খানিকটা। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে, বাঙালিদের ওপর তিনসুকিয়ার মতো হামলা যেন আর না হয়। বিজেপি রাজ্য শাখার প্রধান দিলীপ ঘোষ আবার চিঠিটি লিখেছেন বাংলায়। বলা বাহুল্য, সেটাও রাজনৈতিক প্রচারের প্রয়োজনেই।

মমতা যেভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান কান্ডারি এখন
বরাবরই বিজেপির আসাম রাজনীতির বড় এক টার্গেট বাংলাদেশ। রাজ্যজুড়ে নাগরিকত্বের নিবন্ধন উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল বাংলাভাষী লোকজনের এক অংশকে নাগরিকত্বহীন করতে। এতে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের ‘অবৈধ–বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করে প্রচারণা চালানো যেত। ভারতের এই অঞ্চলে মুসলমানভীতি আরও বাড়াত তাতে। এভাবে ২০১৯ সালের ভোটের রাজনীতিতে হিন্দুত্বের পরিচয়কে আরও দামি পণ্য করে তোলা যেত।

বিজেপি ভেবেছিল, এনআরসি বা নাগরিকত্বের নিবন্ধনে আসামে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রধানত বাংলাভাষী মুসলমানরা। কিন্তু গত ৩০ জুলাই নিবন্ধনের ফল ঘোষণার দিন দেখা গেল, বিপুল সংখ্যায় নমশূদ্রও নাগরিকত্ব হারাল। সব মিলে ৪০ লাখ মানুষ সেখানে অবর্ণনীয় হয়রানিতে এখন। আসামজুড়ে নিবন্ধনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১৭ জন মানুষ এ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন। অভূতপূর্ব দমবন্ধ এক পরিস্থিতি এখন সেখানে।

নিবন্ধন নিয়ে আসামের পরিস্থিতি ভীতি ছড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। অথচ বিজেপি চাইছিল আসামের পর পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিকত্বের যাচাই-বাছাই শুরু করতে, যাতে এখানেও একদল মানুষকে নাগরিকত্বহারা করে অবৈধ অনুপ্রবেশের নামে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা তীব্র করা যায়। বিজেপির জনসভাগুলোয় সভাপতি অমিত শাহ প্রকাশ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারীদের একাংশকে বাংলাদেশি বলেন। বাংলাদেশ এরূপ তথ্য-উপাত্তবিহীন প্রচারণার প্রতিবাদ করে থাকে সামান্য ক্ষেত্রেই। কিন্তু মমতার সফলতা হলো বিজেপির ‘বাংলাদেশবিরোধী’ রণকৌশল তিনি পজিটিভলি গ্রহণ করে তাকে ‘বাঙালিবিরোধী’ তকমা দিতে পেরেছেন। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসামজুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান এক কান্ডারি এখন মমতা। তাতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হিন্দু-মুসলমান বিভেদের রাজনীতি প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বামদের শ্রেণিরাজনীতিও তাতে কিছুটা আবেদনহারা। ‘হিন্দুত্ব’র মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এখন ‘বাঙালিত্ব’। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বোঝা যাবে মমতার কৌশল কতটা কেজো।

৫ বাঙালি খুনের পর আসামে সেনা পাহারা।
৫ বাঙালি খুনের পর আসামে সেনা পাহারা।

বিবাদের কেন্দ্রে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ডে আসামেও বিজেপি বিপদে। আসামের রাজনীতি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী এবং আঞ্চলিক হিসাবে জটিলভাবে বিন্যস্ত। সেখানে ভৌগোলিক একটা বিভেদরেখা হলো ‘আপার আসাম’ ও ‘লোয়ার আসাম’। আবার আছে ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি বনাম বরাক ভ্যালি। বরাক ভ্যালি বাঙালি–অধ্যুষিত। তিনসুকিয়া আপার আসামে। কিন্তু সেখানে বাঙালি হত্যায় বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ বরাক ভ্যালি। বরাক ভ্যালিতে মাওলানা আজমলের মুসলমানপ্রধান রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক মোর্চার প্রভাব কমাতে কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির স্থানীয় হিন্দুদের ঘিরে বিজেপির যে ভরসা, তাতে ঘা দিয়েছে তিনসুকিয়া হত্যা।

নাগরিকত্বের চূড়ান্ত নিবন্ধনে বিপুলসংখ্যক হিন্দুও বাদ পড়ায় বিজেপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তারা আসামের এনআরসিতে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এও জানানো হয়, নাগরিক আইনের এই সংশোধন থেকে মুসলমানদের বাদ রাখা হবে। আসামজুড়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বাড়ানোই এমন সাম্প্রদায়িক নাগরিক আইনের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বিজেপির এই কৌশল ভয়ংকরভাবে বিপদ ডেকে এনেছে। এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা দেখা দিয়েছে আসামের ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির অসমিয়াদের তরফ থেকে। তাদের শঙ্কা, এতে রাজ্যে সংখ্যাগত হিস্যা কমে যাবে তাদের। অসমিয়াদের প্রধান দল আসাম গণপরিষদ রাজ্যে বিজেপির মিত্র। এদের প্রভাব বেশি আপার আসামে। তাই ব্রহ্মপুত্র ভ্যালিতে বিজেপি এখন বিপদগ্রস্ত। সেখানে উলফার সাবেক গেরিলা নেতা অনুপ চেটিয়া হুমকি দিয়েছেন, বিজেপি নাগরিকত্ব আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনী আনলে আসামজুড়ে আবার রক্তগঙ্গা বইবে। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনবে কি না, এ নিয়ে বিজেপিও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এই আইন থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি খানিকটা লাভবান হতে পারত। কারণ, এই আইন পশ্চিমবঙ্গের অনেক হিন্দু উদ্বাস্তুকে নাগরিকত্বের স্বাদ দেবে। কিন্তু একই আইন নিশ্চিতভাবে আসামে নতুন করে সহিংসতার বিস্তার ঘটাবে।

এমন জটিল সমীকরণের মাঝেই তিনসুকিয়ায় পাঁচ বাঙালিকে জীবন দিতে হলো। এখনো এই হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা হয়নি। কিন্তু বিজেপি খুব করে চেষ্টা করছে হত্যার দায় আপার আসামে উলফার পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন গ্রুপটির ঘাড়ে চাপাতে। তিনসুকিয়া হত্যাকে পুঁজি করে ইতিমধ্যে আপার আসামে উলফার বিরুদ্ধে ব্যাপক সেনা অভিযান শুরু হয়ে গেছে। তবে পরেশ বড়ুয়ার উলফা জানিয়েছে, ১ নভেম্বরের হত্যা তারা ঘটায়নি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওখানে প্রতিদিন পুলিশ টহল থাকলেও হত্যার দিন সেটা ছিল না। ফোন করেও থানা থেকে চটজলদি সাড়া মেলেনি। এর ফলে এমনও সন্দেহ হচ্ছে, তিনসুকিয়া হত্যায় আরএসএস ক্যাডারদের হাত থাকতে পারে। হয়তো অসমিয়াদের সঙ্গে বাঙালিদের বিভেদ বাড়াতেই এই হত্যালীলা।

ইতিমধ্যে বাঙালিদের ডাকে আসামজুড়ে ৩ নভেম্বর ‘বন্‌ধ্‌’ হয়ে গেল। বরাক ভ্যালিতে এই বন্‌ধ্‌ সফল হলেও রাজধানী গুয়াহাটি এবং আপার আসামে তার প্রভাব পড়েছে কম।

খুন ও বন্‌ধের পর আসামজুড়ে এখন জাতিবাদী বিভেদ ও উত্তেজনা উত্তুঙ্গ অবস্থায় আছে। যেকোনো সময় আরও দাঙ্গা ও খুনোখুনি হতে পারে; বিশেষ করে নির্বাচনী দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসবে। বহু বছর ধরে চলমান বিজেপির বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতির কারণে আবারও বলি হলো আসামের শান্তি ও স্বস্তি। আপাতত এ থেকে আসামের মুক্তি নেই। মমতা চেষ্টা করছেন এই আগুন থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাতে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক