আমার আলোর রশ্মি

প্রথম আলোর লোগোয় ব্যবহৃত হয়েছে সূর্যের রশ্মি মাত্র পাঁচটি। ভাবতে অবাক লাগে, কী বিস্ময়করভাবে প্রথম আলোর দ্যুতি পাঁচ মিলিয়নেরও অধিক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে রোজ। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৮ সালে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমি তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বিষয়টি হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে; কিন্তু এটাই সত্য যে প্রথম দর্শনেই সংবাদপত্রটির জন্য আমার মধ্যে প্রচণ্ড ভালো লাগা তৈরি হয়। কারণটি অবশ্য আমার অজানা নয়। পত্রিকাটির গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য বুদ্ধির যে পরিপক্বতা থাকা প্রয়োজন, আমার তা কতখানি ছিল জানি না। তবে একটি কথা প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে, ‘আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী’। সেই মানদণ্ডেই হয়তো প্রথম দর্শনেই প্রথম আলোর প্রেমে পড়ি আমি। সবকিছু ছাপিয়ে প্রথম আলোর নান্দনিক লোগোটি আমার মন ছুঁয়ে যায়। মোটা কালো হরফে লেখা ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে উদীয়মান সূর্যের লাল আভা সেই প্রথম দিনই আমার কিশোরী মনটি রাঙিয়েছিল অদ্ভুত এক ভালো লাগায়। সেই ভালো লাগা সময়ের পরিক্রমায় এতটুকু বিবর্ণ হয়নি। পরে জেনেছি, প্রথম আলোর লোগোটির স্রষ্টা সর্বজনশ্রদ্ধেয় গুণী শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথম আলোর লোগোতে ব্যবহৃত ‘প’-এর মাঝখানটা দ্বিখণ্ডিত। মনে পড়ে, নিজের ডাকনামের আদ্যক্ষর ‘প’ হওয়ায় প্রথম আলোর প-এর নকশাটি অনুকরণ করে নিজের নামটি লিখেছি বহুবার। শুধু তাতেই থেমে থাকিনি। ‘প’-এর পাশে জুড়ে দিয়েছি উদীয়মান লাল সূর্য। তাতে লাল রংও করেছি। এমনকি সূর্যের পাঁচটি রশ্মি দিতে পর্যন্ত ভুলিনি।

খুব সকালে যখন আমি অফিসের পথে পা বাড়াই, ঠিক তখনই দরজার সামনে পড়ে থাকা প্রথম আলো আমার দিনের শুভ সূচনা করে। অফিসের তাড়ার কারণে তখন আর পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু অফিসে পৌঁছেই চা হাতে অনলাইনে প্রথম আলোর সঙ্গে কিছু সময় না কাটালে কি চলে! প্রথম আলো ছাড়া আমার কর্মদিবসের শুভ সূচনা কি হতে পারে? আবার সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে হাতে তুলে নিই প্রথম আলো। পড়ে ফেলি সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়সহ ফিচার পাতাগুলো। সেই যে ১৯৯৮ সালে সংবাদপত্রটির সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল, গত ২০ বছরে সেই সখ্য নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে। প্রথম আলো আমার এমন এক বন্ধু, যাকে ছাড়া এক দিনও চলে না। প্রথম আলো আমার কাছে এক প্রশান্তি, আস্থা, বিশ্বাস আর নির্ভরতার নাম। এটি আমার আশ্রয়ও বটে। সামাজিক প্রচারমাধ্যমের হাজার হাজার আসল আর নকল খবরের ভিড়ে আমি যখন বিপর্যস্ত, তখন আমার পাশে আস্থার আলো হয়ে আসে প্রথম আলো। মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে কাটানো হিসাবি জীবনেও কখনো হাতছাড়া করিনি এই সংবাদপত্র। আমাদের সময় ইন্টারনেটের আবির্ভাব হলেও তা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। তাই হলের সংবাদপত্রের কক্ষে ছিল আমার নিয়মিত যাতায়াত। সেখানে অনেক ধরনের সংবাদপত্র ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মনের খোরাক মেটাত প্রথম আলো। তাই অন্যান্য খরচ কমিয়ে হলেও প্রথম আলো কক্ষে রাখতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সময় নিয়ে প্রতিটি খবর পড়তাম। বিয়ের পর নিয়মিত সংগ্রহে রাখতাম নকশায় পরিবেশিত রান্নার রেসিপি। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ পরবর্তী সময়ে নকশার সেই রেসিপিগুলো নিয়ে গুলো বই প্রকাশের জন্য, যা আমার মতো অনেককেই হয়তো রেসিপি সংগ্রহের ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

প্রথম আলো ২০ বছর পূর্ণ করেছে। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতি সেই কিশোর বয়সে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা এতটুকু কমেনি, বরং দিন দিন বেড়েছে। অপরিপক্ব বিচার-বিশ্লেষণে জন্ম নেওয়া কিশোর বয়সের ভালোবাসা আজ পূর্ণতা পেয়েছে। প্রথম আলোর প্রতি পরিণত বয়সের আমার এই মুগ্ধতা আজ শুধু লোগোতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রথম আলো আজ আমার কাছে এক বিস্ময়ের নাম, যা তার স্বকীয়তা, নিরপেক্ষতা, সাহসিকতা আর সৃজনশীলতায় অনন্য। প্রথম আলো নিজেকে শুধু সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং সংবাদপত্রের এই চিরাচরিত ধারাকে ছাপিয়ে তা হয়ে উঠেছে জনগণের পত্রিকা, জনগণের সেবায় নিবেদিত পত্রিকা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংবাদপত্রটি পৌঁছে গেছে গণমানুষের দোরগোড়ায়। বন্যায়, ভূমিকম্পে,অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু, যেমন: বাল্যবিবাহ, অ্যাসিড-সন্ত্রাস, মাদক, যৌতুক ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিয়েছে কঠোর অবস্থান। তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত ও সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। মেধার অন্বেষণ ও বিকাশে অব্যাহত রেখেছে শিক্ষাবৃত্তি, গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগসহ নানা আয়োজন। প্রথম আলো বন্ধুসভা ও পাঠক সমাবেশের অংশ হতে পেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়, এ সময়ে তা সত্যি বিরল ও ঈর্ষণীয়।

প্রথম আলোর সঙ্গে বেড়ে ওঠা এই আমি যা কিছু ভালো, তার সবটুকু নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছি কি না জানি না। তবে প্রথম আলোর আলোয় আমি আজ আলোকিত—এ কথা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারি। প্রথম আলো আমাকে বদলে দিয়েছে এবং আমি বদলাতে পেরেছি আমার পারিপার্শ্বিকতার অনেক কিছুই। আবার অনেক কিছুই পারিনি। আমি জানি, আমরা যা পারিনি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা করে দেখাবে। প্রথম আলোর কাছে প্রত্যাশা, তুমি এভাবেই আমাদের পাশে থাকো, আমাদের পথ দেখাও। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত প্রথম আলোর যৌবন অক্ষয় হোক, অভিজ্ঞতায় আরও সমৃদ্ধ হোক, বিকশিত হোক। প্রথম আলোকে সঙ্গী করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এগিয়ে যাক ভালোর সঙ্গে আলোর পথে। নিরন্তর শুভকামনা প্রথম আলোর জন্য।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]