তবু এগিয়ে সংবাদপত্র

১ নভেম্বর একটি আবেগঘন লেখা লিখেছেন হেদিজে সেনগিজ। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাঁর। খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে। তুরস্কের কর্মকর্তারা এখন ধারণা করছেন, তাঁকে দূতাবাসে শুধু কেটে টুকরো টুকরো করা হয়নি; তাঁর লাশও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে অ্যাসিডে ডুবিয়ে বা খণ্ড খণ্ড করে সৌদি আরবে নিয়ে। জামাল খাসোগির নৃশংস হত্যার বিচার চেয়েছেন হেদিজে। লিখেছেন: আমাদের সবাইকে অবশ্যই এমন একটি পরিষ্কার বার্তা দেওয়া উচিত, যেন কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো আর কখনো সাংবাদিক হত্যা করতে না পারে। তবে এই বার্তা বিশ্বনেতারা কতটা দিতে পারবেন, সন্দেহ। সৌদি রাজবংশ, বিশেষ করে খাসোগি হত্যার সন্দেহের তির যাঁর দিকে, সেই মোহাম্মদ বিন সালমান অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে আমেরিকা এমনকি ইসরায়েলের বড় মিত্র হিসেবে পরিচিত। খাসোগি হত্যার জন্য আর যা–ই হোক, সালমানের বিচার করতে বাধ্য করা হবে সৌদি আরবকে, এটি বিশ্বাস করার লোক পৃথিবীতে আছে কি না সন্দেহ।

ওয়াশিংটন পোস্ট–এর কলামিস্ট জামাল খাসোগির নির্মম বলিদান বরং সংবাদপত্র আর সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতার চ্যালেঞ্জকে নতুন করে তুলে ধরেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যক্তির বাক্স্বাধীনতারই একটি অংশ। খাসোগি প্রাণ দিয়েছেন সৌদি আরবে নিপীড়ন আর অপশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের জন্য। তিনি অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত একটি গণমাধ্যমে এটি করেছেন বলে তাঁর প্রতি রোষ ছিল বেশি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখে আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন, এমন আরও কিছু সৌদি নাগরিকের নাম এখন উঠে আসছে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর। উঠে এসেছে সেখানে স্বাধীন মতামত প্রকাশ রুদ্ধ করার জন্য আরও বহু ধরনের নিপীড়নের সংবাদ। সৌদি আরব কোনো ব্যতিক্রম নয়। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকের উত্থান, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, মাদক ব্যবসায়ীদের প্রভাব বৃদ্ধি ও কিছু অঞ্চলে জাতিগত বিরোধের জের হিসেবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, কমেছে স্বাধীন সাংবাদিকতার সীমানা।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের হিসাব অনুসারে ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ৬৮ জন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে নিহত হওয়া ৯৩৭ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই কোনো বিচার হয়নি। ২০০০ সাল থেকে শুধু মেক্সিকোতে ১১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে; দু–একটি ঘটনা বাদে এ জন্য শাস্তি পায়নি কেউ। খুন করা ছাড়াও তুচ্ছ কারণে গ্রেপ্তার, কারাদণ্ড, পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ, পত্রিকার ওপর নিবর্তনমূলক অর্থনৈতিক পদক্ষেপসহ নানাভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। রাখাইনের একটি গ্রামে নির্বিচার হত্যার সংবাদ রিপোর্ট করার দায়ে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, বুরুন্ডিতে ২০১৬ সালে একজন সাংবাদিক খুন হওয়ার পর থেকে একমাত্র নিরাপদ পথ হয়ে গিয়েছে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সাংবাদিকতা, সাংবাদিকদের জেলখানা হিসেবে পরিচিত তুরস্কে বন্দী আছেন শতাধিক সাংবাদিক। মালয়েশিয়ায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে এমন একটি বিতর্কিত আইন পাস করা হয় যে (অ্যান্টি–ফেক নিউজ আইন) সেপ্টেম্বরেই এটি বাতিল করে দেয় নতুন নির্বাচিত সরকার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বর্গভূমি হিসেবে পরিচিত আমেরিকায় খোদ প্রেসিডেন্ট প্রতিনিয়ত তাঁর সমর্থকদের উত্তেজিত করে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছেন।

অবাধ ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হওয়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল মানুষের মুক্ত মতপ্রকাশের বিচরণভূমি। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। শুধু অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ বছরে মিসর, রাশিয়া, মেক্সিকো, কম্বোডিয়া, রুমানিয়াসহ অর্ধশত দেশে আইন প্রণীত হয়েছে। অথচ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার্থে অনিবার্য হিসেবে দেখা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার দলিল, সংবিধান ও আইনে। এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আদৌ এসব আইন দিয়ে এই স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা সম্ভব কি না?

২.
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণারও বহু বছর আগে থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইন প্রণীত হতে থাকে। ১৭৬৬ সালে সুইডিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রবর্তিত ফ্রিডম অব প্রেস অ্যাক্ট ছিল প্রথম আইন; যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজন থেকে প্রণীত হয়েছিল। এই আইন সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকার অবসান ঘটায় এবং সরকারি কার্যকলাপ অবাধে সংবাদপত্রে প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়।

১৭৯১ সালে আটলান্টিকের অন্য পারে আমেরিকার সংবিধানে প্রথম সংশোধনীতে অন্য বেশ কিছু বিষয়ের সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে বলা হয় যে এই স্বাধীনতা খর্ব করার কোনো আইন পার্লামেন্ট করতে পারবে না। এরপর পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর প্রায় সব সংবিধানে বাক্স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিছু সংবিধানে সরাসরি উল্লেখ রয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথাও। জাতিসংঘের মানবাধিকার দলিলগুলোতে এই স্বাধীনতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মানবাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির ৩৬ নম্বর পর্যবেক্ষণে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া অন্যান্য মানবাধিকার ভোগ করা কষ্টকর, এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়ে বলে বলা হয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় পৃথিবীতে বহু আইন হয়েছে। আইন আছে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ সাপেক্ষে তা বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণেরও। কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীরা বেশি প্রাধান্য দিয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী আইনের ওপর। ইচ্ছেমতো এসব আইন প্রয়োগ করে সংবাদপত্রকে বাস্তবে করেছে আরও অনেক বেশি শ্বাসরুদ্ধ। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়, ব্যতিক্রম নয় এর প্রতিবেশী দেশগুলোও।

৩.
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দুটো দেশ হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। এ দুটি দেশের মধ্যে ভারতের সংবিধানের জনক ড. আম্বেদকার আলাদাভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উল্লেখের বিরোধিতা করেছিলেন এই যুক্তিতে যে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। অন্যদিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংবিধানে বাক্স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই তিন দেশেই এসব স্বাধীনতার ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের বহু সুযোগ রাখা হয়েছে সংবিধানে।

সংবাদপত্র দলনের আইনও প্রচুর আছে এই তিন দেশেই। তবে এর চেয়ে বেশি রয়েছে তা অপপ্রয়োগের নজির। বাংলাদেশে পেনাল কোডে রাষ্ট্রদ্রোহী ও মানহানি মামলা, আদালত অবমাননা আইনে আদালত অবমাননা এবং আইসিটি অ্যাক্টে মানহানি ও ভাবমূর্তি বিনষ্টের অনেক মামলা দায়ের হয়েছে গণমাধ্যমে লেখালেখির কারণে। সম্প্রতি প্রণীত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মানহানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে সবচেয়ে নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন সাংবাদিক ও মুক্ত মতামত প্রকাশকারীরা।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া সংগঠনটির র‍্যাঙ্কিংয়ে একমাত্র শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অবস্থান একসময়ে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ ছিল। দুই বছর ধরে তাদের অবস্থাও আমাদের চেয়ে ভালো। পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে এ বছর বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান আর ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ১৩৯ ও ১৩৮। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ভুটানের র‍্যাঙ্কিং ৯৪।

এসব র‍্যাঙ্কিং আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতো না যদি আমরা নিজেরাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার করুণ চিত্র দেখতে না পেতাম দেশে। বিএনপি আমলের মতো সাংবাদিক হত্যা তেমনভাবে হয় না এখন। কিন্তু গ্রেপ্তার, নিপীড়ন, গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া, কালো আইন প্রণয়ন, হুমকি আর চরিত্র হননের যে চিত্র আমরা দেখি, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ মনে হবে অনেকের কাছে।

আশার কথা হচ্ছে এত বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে এখনো রাষ্ট্রের বা বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সংবাদপত্রই এ দেশে সবচেয়ে সক্রিয় আছে বিভিন্ন অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে।

ধন্যবাদটা সংবাদপত্রেরই প্রাপ্য।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক