এসডিজি ও নির্বাচনী ইশতেহার

২০১৫ সালে জাতিসংঘ যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিল, তার ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে অন্তত ১০টির সঙ্গে যুবশক্তি সরাসরি জড়িত। কিন্তু তিন বছর পার হলেও যুবক বা তরুণদের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশ বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে, সে কথা বলা যাবে না। এখনো আমাদের যুবকদের একাংশ দারিদ্র্যের নিগড়ে বন্দী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আবার নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যেসব তরুণ উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তাঁরাও চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ তাঁদের পেছনে রাষ্ট্র ও পরিবার বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দাবি করেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এক কোটির বেশি যুবকের চাকরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে বিরাট দূরত্ব রয়েছে, সেটিই যুবকদের দুঃসহ বেকারত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষিত যুবকেরা দুটি প্রধান বাধার মুখোমুখি হন। প্রথমত, বাংলাদেশে যেসব কাজের চাহিদা আছে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা তার অনেকাংশই পূরণ করতে পারছে না। এ কারণে বিদেশ থেকে উচ্চ বেতন দিয়ে প্রশিক্ষিত জনশক্তি আমদানি করা হচ্ছে, যঁাদের পেছনে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। অন্যদিকে আমাদের যুবকেরা উচ্চশিক্ষা নিয়েও বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় বাধাটি হলো যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও যুবকদের চাকরি না পাওয়া। যদিও ক্ষমতার দাপট, স্বজনপ্রীতি বা অর্থের জোরে অযোগ্যরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। যেখানে একজন কনস্টেবলের চাকরির জন্য ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয়, সেখানে উঁচু পদের চাকরিতে উৎকোচের পরিমাণ যে আরও অনেক বেশি হবে সেটি বলাই বাহুল্য। আমাদের যুবসমাজের একাংশ যে মাদকাসক্তি ও উগ্রবাদে ঝুঁকে পড়ছে, তারও অন্যতম কারণ বেকারত্ব। কিন্তু সরকার এর সামাজিক প্রতিকার না খুঁজে কেবল শক্তি বলে সমাধানের চেষ্টা করছে।

শিক্ষার বিষয়ে সরকারের উল্লম্ফন নীতিও পরিহার করা জরুরি বলে মনে করি। সরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে যতটা উৎসাহী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করতে ততটাই নিস্পৃহতা দেখিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত পিরামিডের মতো। অথচ সরকারগুলো শিক্ষাকে উল্টো পিরামিড করে এর ভিতটাই দুর্বল করে দিয়েছে। এমনকি তারা ২০১০-এ প্রণীত শিক্ষানীতিও বাস্তবায়ন করছে না। যুগের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার খোলনলচে বদলাতেই হবে।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গত সোমবার ‘যুব সম্মেলন ২০১৮, বাংলাদেশ ও অ্যাজেন্ডা ২০৩০, তারুণ্যের প্রত্যাশা’বিষয়ক মতবিনিময় সভায় যুবকদের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়টি উঠে এসেছে। গত ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্রে তরুণদের যে প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করার কথাও বলেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। তাঁদের এই প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। দেশে বর্তমানে ২ কোটি নতুন ভোটারসহ মোট ভোটারের এক-তৃতীয়াংশই যুবসমাজের অন্তর্ভুক্ত। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের ধারার বাইরে রেখে দেশে টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। তবে উদ্যোক্তাদের এ-ও মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনী ইশতেহারে যুবকদের কথা থাকাটাই যথেষ্ট নয়, নির্বাচনের পর তাঁরা সেই ইশতেহার অনুযায়ী কাজ করেন কি না, সেটাও যাচাই করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে যুবসমাজের উন্নয়নে অনেক কিছু করার কথা বললেও পরে ভুলে যায়। ভবিষ্যতে যেন কোনো দল ওয়াদা ভঙ্গ করতে না পারে, সে জন্য সজাগ থাকতে হবে।