নতুন ব্যাংক অনুমোদন পায় কীভাবে?

গত ২৪ অক্টোবর ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বললেন, ‘ব্যাংকিং খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। অনেক ব্যাংক, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটোই বেশি। এটা মনে হয় সীমিতকরণ দরকার হতে পারে।’ এ খবরটি পরিবেশন করে একটি বাংলা দৈনিকে লেখা হয়েছে, গত ছয় বছরে ১০টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সরকার অনাগ্রহী হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্দশা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। আবার হল–মার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় বিপরীত ধরনের মন্তব্যও করেছেন। তবে এটা সত্যি, সংখ্যায় বেশি হওয়ার পাশাপাশি অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের ভারে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। অতিসম্প্রতি আরও একটি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তিনটি রয়েছে প্রক্রিয়াধীন। আগেই ছিল ৫৮। চারটি যুক্ত হলে হবে ৬২। আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৪। তাহলে দেখা যাচ্ছে সর্বশেষ চারটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রীর সম্মতি নেই। মনে হয় দেশের আর্থিক খাত পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা অনেক কমে গেছে।

নিকট অতীতের তথ্যাদি বলে, এর আগের দফায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে প্রথমে অসম্মতি জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে এগুলোর অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে এসেছিল। কিন্তু সরকারের চাপে লাইসেন্স দিতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে একটি ইংরেজি দৈনিকে লেখা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, তারল্যসংকট, ঋণ জালিয়াতি ইত্যাদি ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। তাঁর মতে, শীর্ষ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এ অবস্থার জন্য দায়ী। তিনি মনে করেন, পরিচালকদের যোগ্য হতে হবে। তেমনি পরিস্থিতির উন্নয়নে শীর্ষ নির্বাহীদের সবল নেতৃত্বও জরুরি। এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত নেই। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দ্রুত ব্যাপক প্রসার ঘটায় এগুলোতে যথেষ্ট দক্ষ ব্যবস্থাপক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তদুপরি অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে বাধা হয় পরিচালনা বোর্ড কিংবা বাইরের কোনো অদৃশ্য সুতার টান।

সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড গঠন করে সরকার। এখানে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকাই বড় হওয়ার কথা। আর বেসরকারি ব্যাংকের আইনে বোর্ডে সংশোধনী এনে মূলত উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণই পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি ব্যাংক থেকে অধিক ঋণসুবিধা পেতে বোর্ড বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কধারীদের তেমন কোনো সমস্যা নয়। জনতা ব্যাংকের একটি অতি বড় অঙ্কের ঋণখেলাপিকে কিছু নিয়মকানুন পালন করে অন্য ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিতে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুনঃ তফসিল ব্যাংক ঋণ পরিশোধের একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া। তবে এ প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণ ঋণ জনতা ব্যাংক থেকে নিয়েছে, তার আকৃতি ও প্রকৃতি গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ বলে একটি ইংরেজি দৈনিকে একাধিকবার খবর বের হয়েছে।

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হবে। উদ্যোক্তারা জোগাবেন প্রাথমিক মূলধন। টাকা রাখবেন আমানতকারীরা। আর ঋণ দিতে হবে ব্যবসা, শিল্প এমনকি ভোগ্যপণ্যের জন্য। ঋণ দেওয়াই তাদের কাজ। সে ঋণ নির্ধারিত কিস্তিতে সুদসহ আদায় হবে। এই সুদের টাকায় ব্যাংকের চলতি খরচ ও আয়কর বাদ দিয়ে বাকিটা মুনাফা। পাবেন উদ্যোক্তারাসহ শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা। কোনো কোনো ঋণ গ্রাহক সময়ান্তরে শিল্প, ব্যবসা বা অন্য ক্ষেত্রে অনিবার্য কারণে খেলাপি হয়ে পড়তে পারে। তখন নিয়ম মেনে করা হয় পুনঃ তফসিল। তবে খেলাপি ঋণ দ্রুত যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা একটি অশনিসংকেত বললে ভুল হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, এ বছরের জুনের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করতে হয়েছে ৩৭ হাজার ২৬০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। একুনে ২৫ হাজার কোটি টাকার অধিক মূলধন ঘাটতি আছে সরকারি–বেসরকারি ১০টি ব্যাংকে। একই সময়ে ৯টি বেসরকারি ব্যাংকসহ ১৩টি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে একটি নতুন মাত্রা নজরে আসবে। আগে প্রধানত সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকত। সে তুলনায় খুবই কম থাকত বেসরকারি ব্যাংকে। এবার দেখা যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৮ হাজার ৯৭৫ কোটি এবং ৪৮ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। বিষয়টি স্বাভাবিক না হলেও কঠিন বাস্তব।

আর অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে এখন অনেকেই ফেরত দিতে চায় না। প্রকৃত শীর্ষ ঋণখেলাপিরা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ পরিশোধের কিস্তি দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্গঠন করে। নাম বাদ পড়ে খেলাপির তালিকা থেকে। সে কিস্তিও পরিশোধ হয় না সময়মতো। আবার সময় বাড়ানো হয়। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, এক ব্যাংকের কোনো কোনো পরিচালক পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে অন্য ব্যাংক থেকে বেনামিতে ঋণ নেন। পরিশোধ করেন না। বহন করতে হয় না খেলাপির দায়।

খেলাপির করালগ্রাস পড়ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তবে একটি বাংলা দৈনিকের খবর অনুযায়ী শিল্প খাত এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এ খাতের বিতরণ করা ঋণের বড় একটি অংশই খেলাপি হয়ে গেছে। এর পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তবে বারবার পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন ইত্যাদি একই কাতারে বিবেচনায় নিলে শিল্প খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা হবে। সে খবরটি অনুসারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। দায়ী গত কয়েক বছরের ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও অনিয়ম।

কম সুদে ঋণ দিলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে—এই প্রস্তাব তুলল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকদের সমিতি। প্রস্তাবটি যৌক্তিক। সরকারও গ্রহণ করল। আর এটা পালন করছে শুধু সরকারি ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে মামুলি দু–একটি ক্ষেত্র ব্যতীত বেসরকারি ব্যাংকগুলো আগের হারেই সুদ ধার্য করে ঋণ দিচ্ছে। বলছে নতুন অঙ্কে আনতে সময় লাগবে। অথচ এটা করতে তাদের দেওয়া হয়েছিল কর রেয়াত। সরকারি সংস্থার আমানতের অর্ধেক টাকা বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ব্যবস্থাও হয়। সুবিধাগুলো সব নিলেন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকেরা। কিন্তু স্বল্প সুদের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা চেপে যেতে চাইছেন; বরং নিজেদের প্রয়োজনে সরকারি ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিচ্ছেন। তাঁদের উদ্যোগ কার্যকর করার দায়িত্ব এখন সরকারি ব্যাংক ও সংস্থার।

ধনী–নির্ধনের সম্পদের ব্যবধান ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। ওপরের আয়ের শতকরা ৫ জনের হাতে দেশের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ সম্পদ। তেমনি নিচের আয়ের ৫ শতাংশের হাতে সম্পদ দশমিক ৭৮ থেকে ৭ বছরে কমে দশমিক ২৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এ তথ্যগুলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের মতে, গিনি সহগ দশমিক ৪৮–এ উঠেছে। আয়বৈষম্যের এ ক্রমবর্ধমান অবস্থায় দেশের অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিচলিত। এক দিকে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। অন্যদিকে বাড়ছে আয়বৈষম্য, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুফলের অনেক বড় অংশীদার ধনিকশ্রেণি। আর এ শ্রেণিটির অনেকেই ব্যাংকের ঋণখেলাপি।

এ ধরনের বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। ঋণখেলাপি সৃষ্টিতে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের একটি ভূমিকা রয়েছে। তাদের আগ্রাসী ঋণদান অংশত এর জন্য দায়ী। এসব প্রতিষ্ঠানের আধিক্যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজে এ কথা বললেও বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়, এটা বোধগম্য হচ্ছে না।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব