নির্বাচনী ট্রেনে বাংলাদেশ

বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গেল। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ নির্বাচনী ট্রেনে উঠে পড়ল। তফসিল অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ২৩ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৯ নভেম্বর। হাতে সময় আছে মাত্র ৯ দিন, এর মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই ও প্রত্যাহার পর্ব শেষে পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার চলবে।

সংসদ নির্বাচনের জন্য অনুকূল আবহ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে সিইসি সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ থাকলে তা রাজনৈতিকভাবে মেটানোর অনুরোধ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বানে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তিনি যখন দাবি করেছেন নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনো বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিরোধী দলের সভা–সমাবেশেও নানা কৌশলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো রাজশাহীতে বিরোধী দলের জনসভার আগের দিন উত্তরাঞ্চলের ১০ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা। এসব অপকৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণায় সবার জন্য সমান সুযোগের ক্ষেত্র নষ্ট করার মাধ্যমে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে না। 

তফসিল ঘোষণার আগে ইসি সভা–সমাবেশের বিষয়ে নিজের দায় এড়িয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। বাংলাদেশের কোথাও কেউ সভা–সমাবেশে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। অন্যথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের শ্রুতিমধুর আহ্বান নিষ্ফল হতে পারে; অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন হতে পারে।

সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছেন যে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ আছে। বিরোধী দলের আপত্তি উপেক্ষা করে ইভিএম ব্যবহারের (তা যত সীমিত পরিসরেই হোক না কেন) একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত? কারিগরি ত্রুটির কথা বাদ দিলেও বাস্তবে আগামী দেড় মাসের মধ্যে নতুন ইভিএম মেশিন আমদানি করা দুরূহ হবে; এই ক্রয় বাবদে অর্থের সংস্থানও এখনো হয়নি। সিইসি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অসামরিক প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য ‘এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’ বিধানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইসিকে মনে রাখতে হবে অসামরিক প্রশাসন সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করলে সেনা মোতায়েন কোনো সুফল দেবে না। ক্ষমতাসীনেরা যাতে কোনোভাবে অসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

সিইসি তাঁর ভাষণে বলেছেন, সবার জন্য অভিন্ন আচরণ ও সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে, এটা শুধু কথায় বললে হবে না, কাজেও প্রমাণ করতে হবে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ও ইসির পক্ষ থেকে এ ধরনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও দখলবাজির ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দলের এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার এবং কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হলেও কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হবে না—এই নিশ্চয়তা কমিশনকে দিতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচন শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য বড় পরীক্ষা নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্যও অগ্নিপরীক্ষা বটে। সংবিধান তাদের কাছে যে ১০ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের আমানত রেখেছে, সেটি তারা কোনোভাবে খিয়ানত করতে পারে না। কঠোর হাতেই তাদের সব ধরনের অনাচার ও দুর্বৃত্তায়ন মোকাবিলা করতে হবে।