নির্বাচন ২০১৮

নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে কিন্তু নির্বাচন–সংশ্লিষ্টদের আচার–আচরণের বিষয়টি এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে নানামুখী উদ্বেগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূচনাতেই একটা ত্রুটি ঘটাল। তারা যে তাদের দায়িত্বশীলতার প্রতি অত্যন্ত সজাগ, সেটা কিন্তু বিএনপি অফিসের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রমাণ করে না। শোডাউন করে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যখন মনোনয়ন ফরম কেনা শুরু করেছিলেন, তখনই তাদের কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করা এবং বিহিত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল।

নির্বাচন কমিশনকে সব সময় মনে রাখতে হবে, তারা কতটা স্বাধীন ও শক্তিশালী, সেটা প্রমাণের জন্য বিরাজমান পরিস্থিতিতে প্রধানত খবরদারিটা সরকারি দলের ওপরই করে দেখাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে একই ধরনের কোনো আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সরকারি দল হলে নীরব, বিরোধী দল হলে সরব থাকার নীতি অনুসরণ করছে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান আচরণবিধিতে অনেক জরুরি বিষয় অনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্ট রয়েছে। বর্তমানে যে আচরণবিধি কার্যকর রয়েছে তা সংসদ ভেঙে দিয়ে যখন নির্বাচন করা হতো সেই সময়ের। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা কেউ প্রার্থী হতেন না। সংসদ সদস্য থাকারই কারও সুযোগ ছিল না। গত নির্বাচন বিরোধী দল বয়কট করার কারণে বিষয়টি খুব সামনে আসেনি। ১৫৩ আসনে ভোটাভুটি হয়নি, সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের তেমনভাবে প্রচারণা চালাতে হয়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ইসির উচিত হবে এই নতুন বাস্তবতা দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।     

এবারের নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য অংশগ্রহণ ইসির অজানা থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তারা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। ইসি যদি শক্ত হাতে গোড়াতেই হাল না ধরতে পারে, তাহলে পরে নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে উঠলে তার পক্ষে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ইতিমধ্যে ব্যাপকতা পেয়েছে। মন্ত্রী-সাংসদেরা প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। দায়িত্বশীলদের অনেকে অবশ্য কথাবার্তায় অপেক্ষাকৃত সংযম বা ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের, বিশেষ করে জনমনে আস্থা সৃষ্টির জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।    

এটা অপ্রিয় সত্য যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের কারণে নির্বাচনী মাঠ সমতল রাখার ধারণায় যে বিরাট ঘাটতি পড়েছে, তা কার্যকরভাবে দূর করা যায়নি। বিকল্প হিসেবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে অনেক আয়োজন করে পাঁচ সদস্যের ইসি গঠন করা হলেও তা শক্তিশালী ও স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করতে পারেনি। আবার সংসদ রেখে ও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তাই বিরোধী দলের মনে আস্থা তৈরির জন্য প্রচলিত আইনের যে পরিবর্তন প্রয়োজন, তা–ও কমিশন করতে পারেনি। তবে সেই সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

আচরণবিধি অস্পষ্ট থাকার বিষয়টি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রশ্নের মধ্য দিয়েও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন সারা দেশে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ও সাংসদদের আচরণ কী হবে। ইসি প্রশ্নোত্তরে যা বলেছে তা লিখিত থাকলে অসুবিধা কোথায়। দেশে নির্বাচন তো ভবিষ্যতে আরও হবে। আসলে সুচিন্তিত কোনো নীতি না থাকলে মন্ত্রী-সাংসদেরাও বিভ্রান্তিতে ভুগবেন। অনেকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আন্তরিক থাকলেও তঁারা নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে অপারগ থাকতে পারেন। আসলে উন্নত সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনকালে বিদায়ী মন্ত্রিসভাটিই যে অন্তর্বর্তীকালীন বা কোথাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ ধারণ করে, সেই বোধটি জাগিয়ে তোলা দরকার। কিন্তু সে জন্য ইসির উচিত হবে আচরণবিধির সব ধরনের অস্পষ্টতা দূর করা। সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে তারা নিজেরাই পরিপত্র জারি করতে পারে।