এবার কঠিন পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ

৩০ ডিসেম্বর কী হবে, অর্থাৎ ভোটের চেহারাটি কেমন দাঁড়াবে, এখন বলা না গেলেও নির্বাচনী খেলাটি যে বেশ জমে উঠেছে, তা অতিশয় নৈরাশ্যবাদী মানুষও অস্বীকার করতে পারবে না। বলা যায়, পুরো বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী ট্রেনে। ডান-বাম-মধ্য-হেফাজতি-জামায়াতি—সবার চোখ এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে।

নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সূচনাপর্ব চলছে এখন। ২৮ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ, এরপর যাচাই-বাছাই এবং ৯ ডিসেম্বর প্রত্যাহারের পরই আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে। তার আগেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরে নির্বাচনী হাওয়া এতটা জোরেশোরে বইতে শুরু করেছে যে তার ঝাপটা এসে পড়েছে জনজীবনেও। কোনো কোনো আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছানোয় খোদ দলীয় প্রধান ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশে এত নেতার জন্ম হলো!

যখন একজন গদিনশিন সাংসদের বিরুদ্ধে ২০-২৫ জন প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি নেতা-কর্মীদের কতটা অপছন্দের। অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া হবে আওয়ামী লীগের প্রথম চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সংসদের সব সদস্যের ভাগ্যে যে এবার মনোনয়নের শিকে ছিঁড়বে না, সে কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় তাদের দলীয় কোন্দল অপেক্ষাকৃত কম। যদিও জোট শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দুই প্রধান দলকেই বড় ধরনের ঝামেলা পোহাতে হবে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অফিসের সামনে মিছিল হয়েছে, রাস্তা বন্ধ করে নেতা-কর্মীরা শোডাউন করেছেন। আবার এই শোডাউনকে ঘিরে প্রাণহানি, বাসে আগুন, সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বিমুখী ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনের তুঘলকি কাণ্ডের কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হোক, তা তারা চায় কি না। প্রথমে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ অফিসে তিন-চার দিন ধরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শোডাউন চললেও নির্বাচন কমিশন টুঁ–শব্দ করেনি। এরপর বিএনপির অফিসের সামনের ব্যস্ততম সড়ক বন্ধ করে যখন নেতা–কর্মীরা দুই দিন ধরে শোডাউন করলেন, তারা তখনো নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু তৃতীয় দিনে নির্বাচন কমিশন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে এই মর্মে চিঠি দেয় যে এভাবে রাস্তায় মিছিল করে মনোনয়ন ফরম নেওয়া নির্বাচনী আচরণবিধির ৮ নম্বর ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, তারা যেন ব্যবস্থা নেয়।

এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ নড়েচড়ে বসে এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

পরদিন আবার নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়, তাদের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। দলীয় অফিসের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মিছিল করতে বাধা নেই। নির্বাচনী অফিসে মিছিল বা শোডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বেআইনি। ফলে বুধবারের অঘটনের পর বৃহস্পতিবারও বিএনপি অফিসের সামনে নেতা-কর্মীদের শোডাউন করতে দেখা যায়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া, গাড়ি ভাঙচুর করার দায়ে বিএনপির ৪৮৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে, ৬৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে এবং ৩৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়। তারা প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীনকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। তিনি বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। পুলিশ হয়তো বলবে, আইনের শাসন কায়েম করতে তারা এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগে মোহাম্মদপুরের আদাবরে আওয়ামী লীগের দুই মনোনয়নপ্রত্যাশীর অনুসারীদের সংঘর্ষে যে দুটি তরুণ প্রাণ ঝরে গেল, কয়েকজন আহত হলো, সেই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিল না কেন? ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে মোহাম্মদপুর যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম ওরফে তুহিনকে তারা গ্রেপ্তার করলেও ১২ ঘণ্টা পর ছাড়া পান। প্রথম আলোর খবর পড়ে অনলাইনে এক পাঠক জানতে চেয়েছেন ‘তাহলে দুটি মানুষের জীবনের চেয়ে পুলিশের গাড়ির দাম বেশি?’

নয়াপল্টনে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার কারণে হুকুমের আসামি হিসেবে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আদাবরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজন মানুষ মারা যাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কোনো ক্ষেত্রে ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিকে শনাক্ত করে রিমান্ডে নেওয়া হবে আর কোনো ক্ষেত্রে আসামি ধরার কয়েক ঘণ্টা মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবেন, এটি আইনের শাসন নয়।

তাই বলছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের নির্বাচনটি নির্বাচন কমিশন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তো বটেই। তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য। ৩০ ডিসেম্বর প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে এবং জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা ভোটারদের কাছে প্রথম, নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রথম, এমনকি নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের কাছেও প্রথম। সংশ্লিষ্ট সবাই কথাটি মনে রাখলে সমস্যা অনেক কমে যাবে, আর না রাখলে কিংবা কোনো পক্ষ থেকে ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা হলে সমস্যা বাড়বে এবং তা নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে চলে যেতে পারে।

আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্বাচন ভীষণ কঠিন পরীক্ষা এ কারণে যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে বর্তমান নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারকেই ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার’–এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।  সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু মন্ত্রী ও সাংসদদের নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি মেনে চললে হবে না, সেই আইন অনুযায়ী জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও চালিত করতে হবে। অন্যথায় সব ব্যর্থতার দায় বর্তাবে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপরই।

নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় দেশের মানুষ, বিদেশের বন্ধু ও সুহৃদেরা এর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশবিষয়ক বিতর্কে অংশ নিয়ে সদস্যদেশের প্রতিনিধিরা এখানে (বাংলাদেশে) মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনই শেষ সুযোগ, যেখানে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা ও আইনের শাসন অব্যাহত থাকবে, নাকি পরিস্থিতি অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হবে।’

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ নয় যে তারা কত বেশি দলকে জোটসঙ্গী করতে পারল, কত আসন পেয়ে সরকার গঠন করল অথবা বিরোধী দলের আসনে বসল; তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না। তাদের চ্যালেঞ্জ হলো মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে যেতে পারবে কি না । প্রতিটি ভাটকেন্দ্রও বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নর্বাচনী এজেন্টরা উপস্থিত থাকতে পারবেন কি না।

নির্বাচন নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা, গুঞ্জন। সবার জিজ্ঞাসা, নির্বাচনটি ঠিকঠাকমতো হবে তো? আমাদের দেশে যতগুলো একতরফা নির্বাচন (১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিসহ) হয়েছে, তার জন্য নির্বাচন বর্জনকারীরা যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী নির্বাচন আয়োজনকারীরা।

২০০৭ সালে বিএনপি ‘সংবিধানসম্মত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে’ দলীয়ভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে নির্বাচনটিই ভণ্ডুল করেনি, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছিল।

এবার আওয়ামী লীগ একই সঙ্গে নির্বাচনে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নির্বাচন পরিচালনাকারীর ভূমিকায় আছে। নির্বাচন পরিচালনাকারী হিসেবে তাকে শুধু নিরপেক্ষভাবে কাজ করলেই হবে না, সেটি জনগণের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হলে, জনগণ আওয়ামী লীগকে টুপি খুলে অভিনন্দন জানাবে। কিন্তু নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ না হলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি