একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই

>১৬ নভেম্বর ঢাকায় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতবিনিময় সভায় দেওয়া বক্তব্যের রেকর্ড থেকে ঈষৎ পরিমার্জিত

আসলে আমি তো একদমই কথা না বলার মানুষ। ছাত্ররাজনীতি করলেও বক্তৃতা দিইনি। কমিউনিস্ট পার্টি করলেও বক্তৃতা দিইনি। আসলে এখানে এত ভালো আলোচনা হয়ে গেছে যে আমি মনে করি, একটু বেশি ভালো আলোচনা হয়ে গেছে। বেশি আশাবাদ তৈরি করে ফেলা হয়েছে। বেশি দাবি করা হয়ে গেছে।

আমি দেখি এভাবে, এক বছরের বেশি সময় আগে এক আলোচনায় ড. আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, আজ মনে হয়, ১৯৭১ সাল থেকে আমরা দূরে, বহু দূরে চলে এসেছি। তিনি আরও বলেছিলেন, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ২৪ বছরের সংগ্রাম ও অর্জনের ধারার সঙ্গে তুলনা করলে তার পরবর্তী ৪৬ বছরের ধারাকে পশ্চাদপসরণ ও বিসর্জনের ইতিহাস বলতে হবে।

অনেক জায়গায় গেলে অনেক মানুষ আমাকে নানা প্রশ্ন করেন। আমি বলি, দেখেন, আমার তো জবাব দেওয়ার সুযোগ নেই, আমি ওই দুই–তিনটি লাইন বলে দিই। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে আমাদের যেসব অর্জন, সেগুলো যদি আমরা বিসর্জন দিয়ে থাকি, যদি তা নষ্ট করে থাকি, তাহলে সবকিছু মিলিয়ে যে অবস্থা বা পরিস্থিতি দাঁড়ায়, ড. আনিসুজ্জামানের সঙ্গে একমত হতে পারি, না–ও হতে পারি, তবে এ কথাটার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ কম।

আমি আশা করি না ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে; ওনার ডানে বা বাঁয়ে বসে আছেন—তাঁদের নেতৃত্বে গত ৪৭ বছরের ভুলভ্রান্তি, ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে মুক্তি পেয়ে দেশ একটা সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরে আসবে, এই বিবেচনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা আমি মোটেই করি না। ড. কামাল হোসেন যে শুরুতে বলেছেন আমাদের রাষ্ট্র, বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য রকমের বিভক্ত—সমাজ, প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তি—এটাকে জোড়া লাগিয়ে যৌথভাবে যুক্ত হয়ে নতুনভাবে আবার সেই অর্জনগুলো ফিরিয়ে আনা অতি দুরূহ, অতি কঠিন কাজ। এই কাজটা আমি মোটেই ঐক্যফ্রন্টকে দিতে চাই না। এটা তাদের ক্ষমতার বাইরে। এটা অবাস্তব, অসম্ভব।

তার মধ্যে ভালোটা এই যে, যা নাঈমুল বলে গেলেন, যে একটা মঞ্চে, যেখানে আ স ম আবদুর রব আছেন, যেখানে কামাল হোসেন আছেন, মাহমুদুর রহমান মান্না আছেন, বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আছেন—এই যে বাংলাদেশে বহুদিন পরে একটা কিছু ঘটল—যেখানে এত ভিন্নমত, এত বিরুদ্ধ মত, চরম বিরুদ্ধ মত; দাঁড়িয়ে যখন কথা বলেন, কেউ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বলেন, বিরুদ্ধে কেউ বলেন না; ভেতরে-ভেতরে থাকলেও বলা হয় না, সমালোচনা, আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক হয় না, এ রকম একটা পরিবেশে, বাংলাদেশের ১০–১৫–৬০ জন নেতা বসতে পারেন, সেটাকেই কিছুটা অগ্রগতি, উন্নতিও বলতে পারেন যে পরিবেশটা কিছুটা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কম করে এইটুকু হলেও আমি অগ্রগতি বুঝি এবং দেখি।

সে জন্য আমি, নূরুল কবীর কিছু মনে না করলে, যে চাওয়ার কথাগুলো বললেন, ভাবনার কথাগুলো বললেন, আমি এগুলো মোটেও ঐক্যফ্রন্টের কাছে আশা করি না। (নূরুল কবীর: আমি চাইতেই থাকব।)

আপনি চাইতেই থাকবেন। এটা আমাদের বামপন্থীদের সমস্যা যে আমরা কেবল চাইতেই থাকি, বক্তৃতা দিতেই থাকি, বাস্তবে সেগুলো পূরণ হয় না। তো একদম ন্যূনতম, আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, সবার অংশগ্রহণ চাই এবং মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে। এখানে যা অনেকেই বলছে, আমরা সেটাই চাই। আর সেটা করার জন্য ঐক্যফ্রন্টের যা যা করা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুবার গেছেন, আরও ২০ বার যাবেন। ইলেকশন কমিশনের কাছে দুবার গেছেন, আরও ৫০ বার যান। প্রতিদিন যান। গিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি আপনারা নিজেদের কাজটা করেন। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে দেশবাসী জানতে পারবে, বুঝতে পারবে আপনাদের চাওয়া, দাবি, প্রয়োজন কী কী, কোথায় কোথায় আপনাদের বাধা, অসুবিধা। গোলাম মোর্তজা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, চিত্র হয়তো তা–ই। সেটাই হয়তো সত্য। এখন এগুলোকে আপনারা কীভাবে কাটাবেন, সে জন্য প্রস্তুতি, আলোচনা, সমাবেশ, মানুষকে বোঝানো—এসব করবেন।

আর সরকারের সঙ্গে গিয়ে বৈঠক করে লাভ হয়নি, একজন বললেন। আমি মনে করি, লাভ কিছু হয়েছে। অন্ততপক্ষে আপনারা তো জনসভাটা করতে পারছেন—একটা, দুইটা, তিনটা। আবারও যান, আবারও কথা বলেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা তো নেই। আর এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমি বলে ফেলি, ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হবে, যেকোনো অবস্থাতে যেতে হবে, নির্বাচনে থাকতে হবে।

আর বিএনপির মহাসচিব গত নির্বাচনে না যাওয়ার কথাটা বলেছেন, গতবারের নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ভয়ংকর ভুল করেছে। এটার জন্য বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চরমভাবে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার এবার এ ধরনের কাছাকাছি চিন্তা করাটা হবে ধ্বংসাত্মক। আর যদি আপনারা আবার কেউ দ্বিতীয়বার কোনো মঞ্চ থেকে বলেন যে এ রকম সম্ভাবনা আপনাদের মধ্যে আছে, তাহলে প্রতিদিনই আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে বলতে থাকব।

আপনারা দল করবেন, রাজনীতি করবেন; আপনারা নির্বাচনে যেতে চাইবেন, আবার চাইবেন না—এটা হতে পারে না, এটা অসম্ভব ব্যাপার। এখানে আওয়ামী লীগ তো কখনো কোনো নির্বাচন বাদ দেয়নি, জিয়াউর রহমান সাহেব ৩৯টি আসন দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন, এরশাদ সাহেব ৭৬টি আসন দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন, জয়ের পথে ছিল আওয়ামী লীগ।

মির্জা ফখরুল ইসলাম, আপনারা এ কথাগুলো বলছেন। আপনাদের উদ্দেশে বলি, নির্বাচনের বিরুদ্ধে বললে আমরা এর বিরোধিতা করব, আপনাদের নির্বাচনে যেতেই হবে, যেকোনো অবস্থাতে। পরিবেশ তৈরিতে কী কী বাধাবিপত্তি, সেগুলো আপনারা বলেন। আমরা বলব, আমরা লিখব, লেখার মধ্যেই আছি। আমরা তো চাই যে সকল রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পাক। নির্বাচন কমিশন করছে না বলে আমরা প্রতিদিনই এ নিয়ে লিখছি। সম্পাদকীয় লিখছি এবং রাজনীতি, মামলা, মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, যা হচ্ছে এগুলো আমরা লিখি, বলি, বারবার বলি, লিখেই চলেছি। এর ফলে চাপ তৈরি হয়, মানুষ জানতে পারে। আমাদের কাজগুলো অব্যাহত থাকবে।

আর বললাম তো, বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসবে, এই আশা করি না। ন্যূনতমপক্ষে দেশে একটা সাধারণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হোক, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হোক, সবাই মিলে আমরা নির্বাচন করি, আমরা ভোট দিই। আর নির্বাচনের ফলাফল যা–ই হোক, সকলে যেন মেনে নিই। মেনে নেওয়ার অভ্যাসটা আমাদের হয়তো অর্জন করা উচিত। ফলাফল নিয়ে আমরা তর্ক করতে পারি, বিতর্ক করতে পারি, ভিন্নমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেলে, গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না, সেটা তো একটা বড় প্রশ্ন আছেই। সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন। আমরাও দেখব, আমরাও বলব। আমরা তো সত্যটাই বলার চেষ্টা করব। এখানে অন্তত এটা কথা দিতে পারি, কখনো কারও পক্ষ হয়ে, কারও বিরুদ্ধ হয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু বলতে যাব না। হতে পারে সব কথা বলতে না পারি, কিন্তু মোদ্দা কথায় আমাদের বক্তব্য আমরা বলব, তুলে ধরব।

আপনাদের ধন্যবাদ, আপনারা আমাদের ডেকেছেন। আমাদের জন্য একটা সমস্যা, আমরা তো আওয়ামী লীগ অফিসেও এখন যেতে পারি না, প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুষ্ঠানেও যেতে পারি না। যা–ই হোক, যেকোনো দল, সরকার বা শক্তি চাইতেই পারে, বিএনপিও অনেক কিছু চায়নি। মওদুদ আহমদ কিছু আইন করার চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা তো চলতেই পারে। এর মধ্যেই আমাদের থাকতে হবে।

আসলে খোলা মনে বললে বলব যে খুব বড় কিছু আশা করি না। আবার এটা অবশ্যই আশা করি যে মানুষের মধ্যে একটা উৎসাহ–উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে, এটা ঐক্যফ্রন্ট হওয়ার কারণে অনেকটা হয়েছে, পরিবেশ অনেকটা বদলেছে। এই বদলানো পরিবেশটা অব্যাহত থাকুক। আমরা সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করব, এইটুকু বলতে পারি। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

মতিউর রহমান: প্রথম আলোর সম্পাদক