খালেদা জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন

গত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর আদালত খালেদা জিয়াকে যথাক্রমে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তাঁর কারাদণ্ড ১০ বছরে উন্নীত করেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন?

বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি... (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বত্সরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

খালেদা জিয়ার নির্বাচন করার যোগ্যতা নির্ভর করবে: (১) তাঁর ‘সেনটেন্স’ বা দণ্ড স্থগিত হয়েছে কি না; (২) তাঁর ‘কনভিকশন’ বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে কি না এবং (৩) সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর।

দণ্ডপ্রাপ্তদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নিয়ে আমাদের উচ্চ আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে, যদিও বিচারের রায় অস্পষ্ট, এমনকি পরস্পরবিরোধী। তবে সব ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন ও আদালত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আপিল দায়ের করে সাংসদ নির্বাচিত হতে কিংবা সাংসদ পদে বহাল থাকতে দিয়েছেন।

মাহমুদুল ইসলামের (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃ. ৪৬১) মতে, যদি দুই বছরের অধিক দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাহলে তাঁকে সে লক্ষ্যে আদালতের কাছে আবেদন করতে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ও ৪২৬ ধারার আওতায় তাঁর কনভিকশনের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পেতে হবে। কারণ, আপিল হলেও কনভিকশন বহাল থেকে যায় এবং আপিলকারী দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হিসেবে গণ্য হন। মাহমুদুল ইসলামের মতে, কনভিকশন ও দণ্ড স্থগিত চাইলেই দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর তা প্রাপ্য নয়। এ ক্ষেত্রে আদালতকে অপরাধের মাত্রা এবং বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে।

সম্প্রতি মো. মামুন ওয়ালিদ হাসান বনাম রাষ্ট্র মামলায় (ক্রিমিনাল মিসলেনিয়াস কেস ১০০০৯/ ২০০৭) বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. খোরশেদ আলম সরকার রায় দেন যে, হাইকোর্ট বিশেষ বিবেচনায় কনভিকশন স্থগিত করতে পারেন, যা নিম্ন আপিল আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্তকে আবেদন করতে হবে এবং দেখাতে হবে যে কনভিকশন স্থগিত না হলে অবিচার হবে এবং তিনি অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

দণ্ডপ্রাপ্তদের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতার বিষয়টি ১৯৯৬ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম এ কে এম মাইদুল ইসলাম মামলার মাধ্যমে একবার আদালতে উত্থাপিত হয়। সে সময়ে জনতা টাওয়ার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত এরশাদ আপিল দায়ের করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। মাইদুল ইসলাম তা চ্যালেঞ্জ করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা এরশাদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন, যার বিরুদ্ধে মাইদুল ইসলাম আদালতের আশ্রয় নেন। মাইদুল ইসলামের রিট আবেদন হাইকোর্ট তাৎক্ষণিকভাবে খারিজ করে দেন। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে [এ কে এম মাইদুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, ৪৮ ডিএলআর (এডি) ১৯৯৬] এরশাদের অযোগ্যতার প্রশ্নটি সুরাহা না করেই বিষয়টি রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষ থেকে ‘নির্বাচনী বিরোধ’ হিসেবে দেখার পক্ষে রায় দেন। একই সঙ্গে বিচারকের এখতিয়ারহীনতা (coram non judice) কিংবা আইনগত বিদ্বেষের (malice in law) অভিযোগ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্বাচনী বিরোধের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় বলে পর্যবেক্ষণ দেন।

পরে ২০০০ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট এরশাদের দণ্ড বহাল রাখেন এবং ৩০ আগস্ট সংসদ সচিবালয় তাঁর সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরশাদ প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনে দাবি করা হয় যে, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য নন। মামলার রায়ে [হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম আবদুল মুক্তাদির চৌধুরী ৫৩ ডিএলআর (২০০১)] বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিচারপতিদ্বয় আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হিসেবে এরশাদের কখন থেকে অযোগ্যতা শুরু হবে, সে ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন রায় দেন যে, আপিল–প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। পক্ষান্তরে বিচারপতি খায়রুল হকের মতে, দণ্ড ঘোষণার দিন থেকেই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার
অযোগ্য হবেন।

মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম বাংলাদেশ [৬২ ডিএলআর (এডি) ২০১০] মামলার রায়ও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। মহীউদ্দীন খান আলমগীর দুর্নীতির দায়ে ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই  দণ্ডিত হন, যার বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর আপিল করেন। হাইকোর্ট তাঁকে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট জামিন দেন এবং ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি তাঁর কনভিকশন ও দণ্ড স্থগিত করেন।

মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কনভিকশন ও দণ্ড হাইকোর্ট স্থগিত করার আগে তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন; তাঁর কনভিকশনের কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তা বাতিল করেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন, নির্বাচন কমিশন ৪ ডিসেম্বর তা প্রত্যাখ্যান করে।

কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মহীউদ্দীন খান আলমগীর হাইকোর্টে রিট করেন, যা হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন। এরপর তিনি হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দাখিল করেন। চেম্বার জজ মো. জয়নুল আবেদীন হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন এবং রিটার্নিং কর্মকর্তাকে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের রিট ‘মেইনটেনেবল’ নয় বলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা বহাল রাখেন। লক্ষণীয় যে আপিল বিভাগ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড কখন থেকে কার্যকর হবে, সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

এ ছাড়া সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাংসদ থাকার অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আবদুর রহমান বদি সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ২০০৮ সালে দুর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হন, যা ২০১০ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল হয়। তিনি ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ তাঁর দণ্ড বহাল রাখেন, তিনি তার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন। সে আপিলে তিনি গত ৮ অক্টোবর খালাস পান। তিনি গত সাড়ে তিন বছর ধরে সাংসদ বা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এমনিভাবে আবদুর রহমান বদিও ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৬ সালে তিন বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত এবং কিছুদিন কারাবাসের পরও আপিল দায়ের করে আজও সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

জিয়া অরফানেজ বা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে। এর একটি বড় কারণ হলো, উভয়েই আপিল দায়ের করে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও, নির্বাচন কমিশন ১৯৯৬ সালে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে, কিন্তু ২০০৮ সালে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র বাতিল করে, যদিও আপিল বিভাগের চেম্বার জজ তা বৈধ করে তাঁকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দেন। হাইকোর্টের দুই বিচারপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত দেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দণ্ডপ্রাপ্তদের যোগ্যতার বিষয়টি দুটি মামলার কোনোটিতেই সুরাহা করেননি। তবে উভয় ক্ষেত্রেই আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন যে দণ্ডপ্রাপ্তদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে, এবং সেই সিদ্ধান্ত এখতিয়ারবহির্ভূত বা বিদ্বেষমূলক না হলে আদালতের তাতে হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। আর কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা নির্বাচনের পরে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে সুরাহা হওয়া আবশ্যক। তাই আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি না, তা মূলত নির্ভর করবে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর।

অর্থাৎ নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কখন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অযোগ্য হবেন—বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রথম দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর না আপিল–প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর—তা এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে; যদিও সব ক্ষেত্রেই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আপিল করে সাংসদ নির্বাচিত হতে বা দায়িত্ব পালন করতে বিরত করা হয়নি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক