বেকারত্ব বাড়ছেই

বাংলাদেশের তরুণদের বেকারত্বের হার সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদি নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। আর বেকারির দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ২৭ নম্বরে, একমাত্র পাকিস্তানের নিচে।

আমরা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছি, কিন্তু কেন সেই  উন্নয়ন–প্রক্রিয়ায় তরুণদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা একেবারেই উদাসীন বলে মনে হচ্ছে। যথা বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় তরুণদের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, তরুণেরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাঁদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি হওয়া ব্যক্তি ও পরিবার তো বেটেই, রাষ্ট্রেরও বিরাট অপচয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার; যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ হলেও এদের একটি বড় অংশ যে পুরোপুরি বেকার অথবা ছদ্মবেশী বেকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  

বাংলাদেশে তরুণদের বেকারত্বের হার বেশি না কম, সেটি জানতে দেশি-বিদেশি জরিপ বা গবেষণার প্রয়োজন নেই। সরকারি কর্মকমিশনে প্রতিবছর চাকরিপ্রার্থীর বর্ধিত সংখ্যা থেকে সেটি অনুমান করা যায়। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় ২ হাজার ২৪টি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার জন চাকরিপ্রার্থী। প্রতি আসনের জন্য লড়বেন ১৯১ জন প্রতিযোগী। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ তেমন না বাড়ায় কর্মসংস্থানও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। তদুপরি বেসরকারি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরিও কম। চাকরির ক্ষেত্রে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আইএলওর প্রতিবেদন মতে, কাজে যুক্ত ৫৪ শতাংশ বাংলাদেশি মনে করেন, তাঁদের যথাযথ হারে বেতন বা মজুরি দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব বলছে, দেশে শ্রমবাজারে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের প্রায় ৭৮ শতাংশ হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। অর্থাৎ এঁদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সরকারের দাবি, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) ১ কোটি ৪০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরও যদি বেকারের হার দ্বিগুণ হয়, তাহলে সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে বিরাট ফাঁক আছে, তা বুঝতে অর্থনীতির পণ্ডিত হতে হয় না। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বেশি হওয়ার কারণ, মুখে যত বড় কথাই বলি না কেন, আমরা আমাদের শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে পারিনি।  একদিকে দেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে, অন্যদিকে উচ্চহারে বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী আমদানি করা হচ্ছে। এই বৈপরীত্য থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার তৈরিতে ব্যস্ত আছে। কিন্তু তাদের ইশতেহারে যুগোপযোগী শিক্ষা ও সত্যিকার মানবসম্পদ উন্নয়নের নিশ্চয়তা থাকবে কি না, সেটাই জিজ্ঞাস্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা যে পিছিয়ে আছি, সেসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের চাওয়া-পাওয়া গুরুত্ব না পেলে উন্নয়নের সব উদ্যোগই ভেস্তে যাবে। বেকারির দেশে টেকসই উন্নয়ন হয় না।