আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র, যানজট ও গণফোরামে যোগদান পর্ব

দলের মনোনীত প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ঢাকা, ২৫ নভেম্বর। ছবি: সাজিদ হোসেন
দলের মনোনীত প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ঢাকা, ২৫ নভেম্বর। ছবি: সাজিদ হোসেন

আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিতরণ নিয়ে রোববার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ অফিস ছিল জমজমাট। যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের উল্লাস যেমন আকাশ স্পর্শ করছে, তেমনি যাঁরা মনোনয়ন পাননি তাঁদের বিষণ্নতায় বাতাস ভারী হয়েছে। 

মনোনয়ন নিতে আসা নেতা-কর্মীদের ভিড় গুলিস্তান জিপিও ছাড়িয়ে পল্টন পর্যন্ত ঠেকেছে। দক্ষিণ থেকে গাড়ি উত্তরে গেলেও উত্তর থেকে কোনো গাড়ি সরাসরি দক্ষিণে যেতে দেওয়া হয়নি। কেননা, সেখানে ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের হাট বসেছে। সকাল থেকেই প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় থেকে জট। এত দিন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রার্থীরা ধানমন্ডির অফিস ও গণভবনে ধরনা দিয়েছিলেন। রোববার তার ফল প্রকাশিত হলো।


বেলা ১টায় কারওয়ান বাজারে থেকে থেকে বের হয়েই কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে দেখি অস্বাভাবিক যানজট। কিছু দূর এগোতে আর যানবাহন চলছে না। কারণ কী কেউ বলতে পারেন না। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পশ্চিম দিকে রাস্তায় কাটাকাটি চলছে বলে বাঁ দিকে মোড় নিতে গিয়ে আরও বিপদে পড়লাম। সবকিছু নিশ্চল। দক্ষিণের সড়কে ভীষণ জট। ভাবলাম, পূর্ব দিকের রাস্তা কিছুটা সচল থাকতে পারে। কিন্তু কাকরাইল মোড়ে গেলে ট্রাফিক পুলিশ সব গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়। বলে, গুলিস্তানে আওয়ামী লীগ অফিসে মনোনয়নপত্র দিচ্ছে, ওদিকে গাড়ি যাবে না। আরামবাগ মোড় ঘুরে ফের পশ্চিম দিকে আসি। কিছুটা সামনে গিয়ে পুরোনো পল্টনের সড়ক ধরে দক্ষিণে যাওয়ার চেষ্টা করি। ভেতরে অলিগলি ঘুরে যখন প্রেসক্লাবে পৌঁছাই, তখন বেলা তিনটা। জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকতেই বিশালকায় ব্যানার। কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন, ধন্যবাদ। কিন্তু যে কারণে অভিনন্দন, সেই প্রস্তাবিত ৩১তলা ভবন নির্মাণের কোনো লক্ষণ নেই।


এই মুহূর্তে প্রেসক্লাবে তিনটি নির্বাচনী হাওয়া। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সাংবাদিকেরা প্রার্থী না হলেও প্রার্থীদের নিয়ে তাঁদের আগ্রহের কমতি নেই। রাজনীতির মতো সাংবাদিকেরাও এদল–ওদলে বিভক্ত। ১৮ নভেম্বর প্রেসক্লাবের নির্বাচন। সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে জোর গুঞ্জন। তবে ৩০ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনের প্রার্থিতা অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়েছে। প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা হতেই নিজের রঙিন ছবিযুক্ত একখানা প্রচার কার্ড হাতে দিয়ে বলেন, ‘ভাই, দোয়া করবেন।’ আবার কেউ কেউ প্রেসক্লাব নির্বাচনে আগাম প্রার্থিতার কথা জানান।


তিনতলায় পৌঁছে দেখি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলন শেষ পর্যায়ে। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অর্ধশত ক্যামেরা ও শ খানেক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে কক্ষটি বেশ সরগরম। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য দেওয়ার পর কামাল হোসেন তখন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।


: সিইসি দাবি করছেন করছেন নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি আছে।
: নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। তারা তাদের বিবেকের কাছেই প্রশ্ন করুক কতটা নিরপেক্ষ।
: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে, এটি তাঁর ব্যক্তিগত কথা না জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য?
: আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়।
সংবাদ সম্মেলনে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী নির্বাচনী পরিবেশ ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সেখানে তিনি তিনটি বিষয়ের কথা বলেন—১. গণভবন, মন্ত্রীদের বাসভবন ও সরকারি অফিস রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু ইসি এখানে নীরব ভূমিকা পালন করছে। ২. আইনবহির্ভূতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধী পক্ষের ওপর মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এসব হচ্ছে এবং এতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ৩. সরকারি দলের প্রার্থীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সহায়তায় প্রচারকাজ করছেন। কিন্তু বিরোধীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।


সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাদের সিদ্দিকী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী ছাড়াও সম্প্রতি গণফোরামে যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এস এম কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মেজর জেনারেল (অব) আমসা আমীন ও একুশে টেলিভিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালামও উপস্থিত ছিলেন।


রোববার কোনো কোনো পত্রিকায় খবর এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এ কে খন্দকার গণফোরামে যোগ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পত্রিকা নিজস্ব ধারণা থেকে খবর করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।’
তবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা ব্যক্তিগত আলাপে বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আরও বেশ কয়েকজন নেতা কাল-পরশুর মধ্যে গণফোরামে যোগ দিচ্ছেন। তিনি কারও নাম বলেননি।


আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকা নিয়ে কদিন ধরেই জোর আলোচনা চলছিল। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলেছিলেন, আজকালের মধ্যে তালিকা পাওয়া যাবে। তারও আগে তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, কোনো বিতর্কিত সাংসদ মনোনয়ন পাবেন না। কিন্তু তালিকা দেখে বুঝলাম, বর্তমান সাংসদের বিতর্কিত ও সমালোচিত প্রায় সব সাংসদই মনোনয়ন পেয়েছেন। যাঁদের বাদ দেওয়া নিয়ে বছরজুড়ে জল্পনা ছিল, যাঁদের সম্পর্কে নেতারা অহরহ নেতিবাচক কথা বলতেন, তাঁরাও সসম্মানে বহাল রয়েছেন। এটাই কি কাজের মূল্যায়ন?


মাঝখান দিয়ে কপাল পুড়ল দলের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমের।


তাহলে মনোনয়ন নিয়ে এত শোরগোল, একবার গণভবন, একবার ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কে সলাপরামর্শেরই–বা কী আছে? বর্তমান সাংসদের তালিকাটি টিকচিহ্ন দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পাঠালেই হতো।


দলের সাধারণ বলেছেন, মনোনয়নপত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাহারপত্রও নিয়ে রেখেছেন। মনোনয়ন দেওয়ার সময়ই যখন তাঁরা বিতর্কিতদের বাদ দিতে পারেননি, তখন প্রত্যাহারের সময় বাদ দিতে পারবেন, সে কথা কেউ বিশ্বাস করে না।