আত্মহত্যাপ্রবণতা ও আত্মঘাতী হামলাপ্রবণতার সম্পর্ক আছে

প্রতিবছর বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে আট লাখ—প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। সারা বিশ্বে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পুরুষ। প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজারের মতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনার পরই আত্মহত্যায় মৃত্যু অস্বাভাবিক মৃত্যুতালিকায় দ্বিতীয় স্থানে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। অর্থাৎ আত্মহত্যাপ্রবণতাও বাড়ছে। পত্রিকাগুলো হুটহাট অগভীর সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছে—‘চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা’, ‘পড়াশোনার খরচ চালাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা’, ‘খারাপ চেহারার কারণে অপমানে আত্মহত্যা’—ইত্যাদি শিরোনামে। এ রকম শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন ক্ষতিকর। কারণ, আত্মহত্যার কারণটি যখন জানাই হয়ে গেছে, পাঠকের গভীর ভাবনা বা কারণ খোঁজার চেষ্টারও আর গরজ থাকছে না। সহজ এই যুক্তিও তখন মাথায় আসে না—আচ্ছা, এসবই যদি কারণ হয়, তাহলে লাখো হতদরিদ্র রাস্তার ভিখারি, গৃহহীন, ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজে নেওয়া মানুষ, পঙ্গুত্ব-অন্ধত্ব-রোগশোকে ওষ্ঠাগত-প্রাণ মানুষগুলো আত্মহত্যা না করে উল্টো বাঁচার আকুতি নিয়ে প্রাণান্ত শেষ চেষ্টা করে থাকে কেন?

আত্মহত্যার অনেক গভীরতর কারণ আছে। সেসব বোঝার পদ্ধতিও আছে। তবে একটি পদ্ধতি বিষয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।

আইএসসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী দলগুলোর ‘সুইসাইড বোম্বার’দের অতীত রেকর্ড এবং মিশনে যাওয়ার আগেই ধরা পড়া ব্যক্তিদের কেস স্টাডিগুলোয় চমকে দেওয়ার মতো জ্ঞান আছে। আত্মঘাতীদের বেশির ভাগই ‘আদর্শ’গত কারণে নয়, নিজেকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক মানুষ খুন করার উদ্দেশ্য নিয়েই সুইসাইড স্কোয়াডে নাম লিখিয়েছিল। অর্থাৎ আগে থেকেই তারা আত্মহত্যাপ্রবণ এবং আত্মহত্যার নিশ্চিত ও সহজ উপায় খুঁজছিল। অনেক ভিন্নধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দেওয়ার সহজ রাস্তা ধরতে।

রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেল, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত, দাগি আসামি, ফেরার, জেল খাটা, ভাঙা ও দ্বন্দ্ববহুল ঘর-সংসারে বিপর্যস্ত শৈশব বা যৌন সহিংসতার শিকার যুবক। পিতৃমাতৃ-পরিচয়হীনতাসহ আরও অসংখ্য কারণে বিষণ্নতায় বিপর্যস্ত ও জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছিল তারা। মরবে এবং মারবে—মগজে এই খুনের আগুন নিয়ে রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোও খুঁজে খুঁজে এদেরই বের করত উদ্দেশ্য হাসিল করা সহজ হবে বলে। অন্যকে হত্যা ও আত্মহত্যার মাধ্যমে বেহেশত পাওয়া গেলে তো বাড়তি লাভ—পাপও হলো না, উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হলো। তাই এরা হত্যার আদর্শকে চট করে আত্মস্থও করে ফেলত সহজেই।

লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের নিজস্ব বিশেষ গবেষণাকে দুনিয়ায় নির্ভরযোগ্য ধরা হয়। এ রকমই একটি গবেষণা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে—দ্য সোসিওলজি অ্যান্ড সাইকোলজি অব টেররিজম: হু বিকাম টেররিস্ট অ্যা ন্ড হোয়াই?’ শিরোনামে। ১৯৯৯ সালের সেই গবেষণাতেই ওপরের কারণগুলো চিহ্নিত করার পরও মার্কিন নেতৃত্বাধীন দুনিয়া ‘মুসলিম টেররিস্ট’, ‘ডেঞ্জারাস আইডিয়লজি’, ‘জিহাদিজম’ ইত্যাদিকে কেন প্রতিষ্ঠা দেওয়া ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে—কারণগুলোও আমরা জানি। বিশ্বরাজনীতি ও যুদ্ধ-পুঁজিবাদ এমনই দাবার ছকে ফেলা একটি নিষ্ঠুর খেলা মাত্র।

দেশে-বিদেশে ভিন্নধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণকারীদের সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস আছে। নানা রকম তথ্যের বিশ্লেষণ করে বিষয়টিতে অস্বস্তি বোধ হয়। ধর্মান্তরের পরপরই ইমাম বা ধর্মীয় নেতারা নও-মুসলিমের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য নির্দোষ এবং মানবিক হলেও গভীর অনুসন্ধানে অনেক সময়ই দেখা যায়, নও-মুসলিমদের কেউ কেউ হয় মাদকাসক্ত, টাকা-পয়সার তাৎক্ষণিক জোগান দরকার; নয়তো ক্রুদ্ধ, কোনো বিষয়ে প্রতিশোধপ্রবণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। নতুবা বিষণ্নতার রোগী। ফ্রয়েডের বলা ‘লাইফ ইন্সটিংক্ট’ অনুযায়ী হয় ‘বাঁচার রাস্তা’ খুঁজতে, নয়তো ‘ডেথ ইন্সটিংক্ট’–এর কারণে হত্যা-আত্মহত্যা-বিনাশের উপায় (যেমন আইসিসে যোগ দেওয়া) হিসেবে তারা সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হঠাৎ আত্মহত্যা বেড়ে গেছে—এ রকম সাধারণীকৃত ভাবনার চেয়ে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন যে আত্মহত্যাপ্রবণতা আরও অনেকের মাঝেই আছে এবং বিপজ্জনক মাত্রাতেই আছে। এতে সমাধানের পথ পাওয়া সহজ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে (২০১৬), আত্মহত্যাকারীদের শতকরা ৭০ ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। আত্মহত্যাচেষ্টা (প্রবণতা) আত্মহত্যারও ২০ গুণ বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে। অর্থাৎ বয়সটি আসলেই বিপজ্জনক। সম্প্রতি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ওপর পৃথিবীজুড়ে তীব্র নজরদারির কারণে তাদের কর্মী সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। সুযোগ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেকে হয়তো সেসব দলে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও নজরে পড়ত না। ঢাকার হোলি আর্টিজানের ও কল্যাণপুরের সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের বেশির ভাগই বিভিন্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রছাত্রীই ছিল।

সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খাইম ১২০ বছর আগে আত্মহত্যার আদ্যোপান্ত নিয়ে গভীরতর আলোচনার শুরু করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞানের অনেকটাই বর্তমান সময়ের উপযোগী না হলেও কয়েকটি অনুধাবন এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: ধর্মানুরাগী, বিবাহিত, সমাজবদ্ধ গ্রামীণ সমাজ, যৌথ পরিবার, কৃষিসমাজ, অপুঁজিবাদী ও প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সমাজে আত্মহত্যাপ্রবণতা কম।

বর্তমান সময়ে গ্রামসমাজে লাগা আধুনিকতার ছোঁয়া, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বিনোদনের উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, উচ্চাভিলাষ, প্রতিযোগিতা, তরতর করে ওপরে উঠতে থাকার অদম্য ব্যগ্রতা-ব্যাকুলতা, সম্পদের অসম বণ্টন, রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট ইত্যাদি বাস্তবতার অনুষঙ্গ হিসেবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মনোদৈহিক জটিলতা—বিষণ্নতা, ক্রোধ ও হতাশা। ফলাফল আত্মহত্যাপ্রবণতা। বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, শারীরিক সৌন্দর্যহীনতা ইত্যাদিকে কারণ দেখানোর মতো সরলীকরণ দ্বারা সংবাদপত্রগুলো দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। এই জটিল মনোদৈহিক সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত ও অবস্থানও লক্ষ করলাম হতাশাকর ধরনের দুর্বল, ভাসা-ভাসা এবং গা-ছাড়া।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের বিশ্বময় আত্মহত্যা জরিপ অনুযায়ী আত্মহত্যার ৭৯ শতাংশই ঘটছে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোয়। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল তিনটি দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ও নেপালে আত্মহত্যার ঘটনা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা তামিল ও শিখ বিদ্রোহে আত্মহত্যা-আক্রমণকারীদের ব্যবহার দেখেছে। ভুটানও একটি আশঙ্কাজনক বৈপরীত্যের উদাহরণ । ‘হ্যাপিনেস ইন্ডিকেটর’ বা ‘সুখ সূচকে’ দেশটি যেমন শীর্ষে, আত্মহত্যায়ও বিপজ্জনক তালিকার ২৫টি দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে। আত্মহন্তাদের বেশির ভাগই অবশ্য নেপালি শরণার্থী, যারা ভুটানের মতো সমতাপন্থী সমাজেও ব্যাপক অসাম্যের শিকার। ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসাম্য বাংলাদেশেও আত্মহত্যার হার বাড়িয়ে দিতে পারে। অতি সম্প্রতি বিভিন্ন মহলে একটি তথ্য আলোচিত হচ্ছে যে ৩০ হাজার অতি ধনীর হাতে জমাকৃত সম্পদের পরিমাণ অপর ১৬ কোটি নাগরিকের সম্মিলিত সম্পদের সমান। তথ্যটি সত্য হলে আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, কর্মক্ষম যুবকেরাই সামাজিক বৈষম্যের প্রাথমিক শিকার এবং যুবকদের আত্মহত্যাপ্রবণতা হতাশাজনিত প্রতিবাদের একটি ধরন হয়ে ওঠে অনেক সময়।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম যেটাকে ‘অল্ট্রুইস্টিক সুইসাইড’ বা ‘পরার্থপর আত্মহত্যা’ বলেছেন, এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তা নয়। ধরা যাক, কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর হাতে নিশ্চিত ধরা পড়বেন বুঝে আত্মবিসর্জন দিলেন। কারণ, ধরা পড়লে শত্রুরা সহযোদ্ধাদের তথ্য, যুদ্ধকৌশল ইত্যাদি জেনে যাবে; লোকক্ষয় হবে। এই ধরনের পরার্থপর আত্মহত্যা এখন কোথাও দেখা যায়না। গত এক-দেড় দশকের আত্মঘাতী হামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা অত্যন্ত সহজ যে ফ্রয়েড বর্ণিত ‘ডেথ ইন্সটিংক্ট’ই আত্মঘাতের মূল অনুঘটক। আত্মহত্যাপ্রবণতা এবং আত্মঘাতী-হামলাপ্রবণতা পরস্পর সম্পর্কিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে সতর্কতাবাণী বিবেচনায় নিয়ে নাগরিকদের চোখ-কান খোলা রাখা প্রয়োজন।