মাঠ না দেন, ঘরের খেলাটা তো দেবেন!

কাছাকাছি খেলার মাঠ বা পার্ক না থাকায় বাইরের বা আউটডোরের খেলাগুলো শিশুদের খেলার সুযোগ থাকে কম। অবশ্য অভিভাবকদের দুজনেই নিজ নিজ কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলেও শিশুদের প্রতিদিন ঘরের বাইরে গিয়ে খেলার সুযোগ হয় না। সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশ আমাদের ভেতরে একরকমের অলসতা তৈরি করে। আমরা নিজেরাও বাইরে বের হলে শুধু খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে কোথাও যাই না। ঢাকা শহরে যারা বসবাস করি, তাদের বেড়াতে যাওয়ার বেশির ভাগ স্থান শপিং মল বা খাবারের স্থানগুলোকে কেন্দ্র করেই! এসব জায়গায় শিশুদের শারীরিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় খেলাধুলা অসম্ভব। তাহলে উপায়? খেলাধুলাকে শিশুদের প্রতিদিনের জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে?

আসলে চেষ্টা করে আউটডোর খেলাগুলোর কিছু আমরা ইনডোর বা ঘরের মধ্যে খেলতে পারি। কারণ, চাইলেও প্রতিদিন বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ হয় না। খেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই হপস্কচ বা ফোরস্কয়ারের নাম বলা যায়—আমরা যাকে এক্কা-দোক্কা বলে থাকি। ঘরের ভেতরেই চক বাদ দিয়ে ফ্লোরে মাস্কিং টেপ লাগিয়ে খেলার ঘরগুলো তৈরি করা যায়। খেলা শেষে মাস্কিং টেপ খুলে ফেললেই হলো! এ ছাড়া দড়িলাফ, হুলা হুপিং, বাড়ির কারও সাহায্য নিয়ে কোনো কিছু বেয়ে ওঠা, যেমন গ্রিল অথবা টেবিলের নিচ দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া অথবা ছোট কোনো টুল বা কিছুর ওপর দিয়ে লাফিয়ে যাওয়া আর সেটা অবশ্যই অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে, ডার্ট বোর্ড দিয়ে লক্ষ্যকে তাক করার অনুশীলন (ডার্টস), কাগজ দিয়ে প্লেন বানিয়ে ওড়ানোর অনুশীলন করা (পেপার প্লেন কমপিটিশন)। এ ছাড়া বোলিং সেট দিয়ে খেলা, প্লে ম্যাটও আজকাল ঘরে বসেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিনতে পাওয়া যায়। সেটা দিয়েও নানা রকমের খেলাধুলা করা যেতে পারে। এভাবে আরও একটু ভাবলে শারীরিক বেশ কিছু কসরতের খেলা শিশুরা ঘরে বসেই খেলতে পারে। তবে সেটা অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।

শুধু শারীরিক কসরতের জন্যও নয়, আসলে শিশুদের মানসম্মত উপায়ে সময় কাটানোটাও জরুরি। তবে ইনডোরে আরও চমৎকার কিছু খেলা, যেমন হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলা শিশুরা খেলতে পারে। এই খেলা বাস্তব জীবনের সঙ্গে বেশ সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে পুতুলখেলাও প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে শিশুদের কল্পনার সঙ্গে মিলে যায়। এ ধরনের খেলার মধ্য দিয়ে শিশুরা তাঁদের খেলার সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। কেবল টেকনোলজির ওপর ভর করে শিশুদের সময় কাটাতে দেওয়া যায় না। কারণ স্থূলতা, আসক্তি, চোখের দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা, অসামাজিক আচরণ, লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগিতাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরও কিছু বিষয়, যেমন অবসরে বই পড়ার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ক্ল্যাসিক বই, যেগুলোর অনলাইন কোনো কপি নেই, সেগুলো শিশুদের নাগালের মধ্যে পৌঁছায় না। আসলে টেকনোলজি খারাপ নয়, বরং একুশ শতকে টেকনোলজি ছাড়া চলবেই না। টেকনোলজির ব্যবহার তাই করতে হবে এবং ব্যবহার জানতে হবে। কিন্তু ব্যবহারটা আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছাতে দেওয়া যাবে না। টেকনোলজি, যেমন: টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল—এগুলো সারা দিনে অন্যান্য কার্যক্রমের ফাঁকে ফাঁকে রাখতে হবে। পাশাপাশি সৃজনশীল উপায়ে সময় কাটানোর উপায়ও বের করতে হবে।

একটা শিশু যখন খেলাধুলা করে, তখন তার শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনেও আসে প্রশান্তি। তবে খেলার ধরনের ক্ষেত্রে শিশুরা ইচ্ছেমতো বা অভিভাবকদের মাধ্যমে শিখেও খেলাধুলা করতে পারে। এই দুই ধরনের খেলাই শিশুদের মধ্যে সামাজিক জীব হয়ে ওঠার সামর্থ্য তৈরি করতে সক্ষম। পাশাপাশি সেলফ রেগুলেশনের ক্ষেত্রেও খেলাধুলা ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে নিজ নিজ আচরণ সংশোধন করে নেওয়া এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও তৈরি হয়। তবে বিশেষভাবে শিশুরা যখন ইচ্ছেমতো খেলে, তখন ইনডোর ও আউটডোর দুই ক্ষেত্রেই অন্যের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে, টার্ন টেকিং করতে শেখে, নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের সঙ্গে সমঝে চলতেও শেখে। আসলে খেলাধুলা শেখায়, কী করে বন্ধু তৈরি করে জীবনের পথে এগিয়ে চলতে হয়।

খেলাধুলার মধ্যমে শিশুরা কেবল সময় কাটায় না, বরং শেখে—এটা আসলে অনেক অভিভাবকই বুঝতে পারেন না। তাই শিশুদের খুব আর্লি পি-স্কুলে দেওয়ার একটা তাড়া তাঁদের থাকে। এঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, বাসায় বসে না থেকে স্কুলে গিয়ে খেলাধুলা করে সময় কাটাক। কিন্তু অভিভাবকেরা নিজেরাই যদি ইনডোর ও আউটডোরের খেলাধুলা সম্পর্কে ধারণা রাখেন এবং খেলাধুলার উপকারিতা সম্পর্কে জানেন, তাহলে চাকরিজীবী হোন বা না হোন, ঠিক ঠিক সময় বের করে শিশুদের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটাতে পারেন। এতে করে সময়ের বহু আগে স্কুলে দিয়ে শিশুদের ওপর একাডেমিক পড়াশোনার চাপ পড়ে না। বরং বাড়িতেই হেসেখেলে সুন্দর পরিবেশে স্কুলের পড়াশোনার জন্য শিশুরা প্রস্তুত হয়ে যায়। শুধু জানতে হয়, কোন ধরনের খেলাধুলায় কী ধরনের আউটকাম হয়। কোন বয়সে কী ধরনের খেলাধুলার সামর্থ্য তৈরি হয়। কোন বয়সে পৌঁছে শিশুরা কী ধরনের সক্ষমতা অর্জন করে। সে ক্ষেত্রে ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন সম্পর্কে ইন্টারনেটে অভিভাবকেরা তথ্য খুঁজতে পারেন।

আসলে সময় নেই—এটা এক অর্থে অজুহাত। সময় কম থাকলেও কিছু কোয়ালিটি সময় বের করে নেওয়াই যায়। যেমন পথ চলতে চলতে সপ্তাহের নতুন খেলা খুঁজে বের করা, ডেভেলপমেন্টাল মেইলস্টোন সম্পর্কেও জেনে নেওয়া, এমন অনেক কিছুই সম্ভব। আসলে খুব ভালোভাবে সময় কাটাতে পারলে এক ঘণ্টাও শিশুর জীবনে বড় রকমের প্রভাব ফেলে। খেলতে খেলতে একটা সময় গিয়ে দেখা যায়, শিশুটি তাকে শেখানো বিষয়গুলো রপ্ত করে ফেলেছে। তবে একটা ইনডোর অ্যাক্টিভিটি, যেটা প্রতিদিন শিশুর ঘুমাতে যাওয়ার আগে করা যায়, সেটা হলো গল্প পড়ে শোনানো। তিন বছরের নিচে শিশুরা গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনবে, তা নয়, তবে গল্প বলে গেলে একটা সময় শোনার, গল্প পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। নতুন নতুন শব্দ শোনা, শেখা, বলতে পারা, মুখের অভিব্যক্তি রপ্ত করাসহ আরও দারুণ সব পরিবর্তন সময়ের সঙ্গে আসতে পারে। কাজেই মূল বিষয়টা হলো ইনডোর খেলাকে স্বাগত জানানো। আর এসব খেলায় আরও সৃজনশীল হয়ে ওঠা।