সড়কে আর কত মৃত্যু?

বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন একেকটা ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ; কোন মুহূর্তে কার প্রাণ যাবে, কেউ বলতে পারে না। এমনকি একটি পরিবারের সব সদস্যের মৃত্যুর ঘটনাও এই দেশে খুব বিরল নয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত দেশের ৯টি জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন মানুষ।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত বেশি—প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই হার প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মাত্র ৩। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কত লোক নিহত হন, তা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি তিন-চার হাজারের বেশি নয়, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে তা ২০ থেকে ২১ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামের এক বেসরকারি সংস্থা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে হিসাব করে যে পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে, তাতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার পর্যন্ত মানুষ।

এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অতি উচ্চ হারের কারণগুলো বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে চিহ্নিত করেছেন। একটি প্রধান কারণ নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে যান চালানোর প্রবণতা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়কের সংকীর্ণতা, বিপজ্জনক বাঁক ইত্যাদি সমস্যাকে ছাপিয়ে যায় বেপরোয়া যান চালানোর প্রবণতা। অনেক চালক রাস্তা ফাঁকা পেলেই যানবাহনের গতি বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়িয়ে দেন, ফলে দুর্ঘটনা বেশি হয়, হতাহত মানুষের সংখ্যাও অনেক বাড়ে। বেপরোয়া যান চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানির দায়ে চালকের বিচার ও শাস্তি হয় না। এমনকি শাস্তির দাবি উঠলে, কিংবা মামলা হলে মোটরযান শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন, মন্ত্রী পর্যায়ের নেতারাও সেই অন্যায় আন্দোলনে ইন্ধন জোগান। এভাবে চালকদের দোষে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাগুলো প্রতিকারহীন থেকে যায়। মোটরযান আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় দণ্ডিত চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড; কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ নেই; মামলা হলে সে মামলার নিষ্পত্তি হয় না।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ—সবাই যেন ধরে নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও অঙ্গহানি যেন অপ্রতিকার্য সমস্যা। কিন্তু এটা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হলে সড়ক দুর্ঘটনার এই অস্বাভাবিক উচ্চ হার অবশ্যই কিছু মাত্রায় কমানো সম্ভব। সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা বাড়ানো কোনো অসম্ভব কাজ নয়। এ জন্য বেপরোয়া যান চালানো বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। লাইসেন্সবিহীন যানচালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন যেন রাস্তায় নামতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।