ধর্মই এখন বিজেপির শেষ ভরসা!

আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতের ৯০ কোটি ভোটার তাঁদের পরবর্তী সরকার নির্ধারণ করবেন। স্বাধীনতার পর এটিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। দেশটিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে।

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি আরও এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেন, তাহলে দেশটিতে সংখ্যাগুরুর একচ্ছত্র শাসন কায়েম হবে। গণমাধ্যমসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিজেপির হাতের মুঠোয় চলে যাবে। বিচার বিভাগ, সরকারি নজরদারি সংস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরও অসহায় হয়ে পড়বে। বিশেষ করে যে সাড়ে ১৭ লাখ মুসলমান ভারতে বাস করে, তারা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

মোদি যে অর্থনৈতিক আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করতে পারেননি। এ কারণে বিজেপির প্রতি মানুষের যে অন্ধ সমর্থন ছিল, তা কমছে। মোদি ভালো করেই জানেন, তাঁর ওপর থেকে জনগণের আস্থা দিনকে দিন কমছে। সে জন্য তিনি সেই পুরোনো পথই বেছে নিয়েছেন। ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তুলতে চাইছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে তিনি সমাজকে আরও বিভক্ত করে ফেলার চেষ্টা করছেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে মানুষ মোদিকে ভোট দিয়েছিল মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, তখন মানুষ কংগ্রেস পার্টির নেতা-কর্মীদের লাগামছাড়া
অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ভীষণ বিরক্ত ছিল। জাতীয় অর্থনীতি তখন একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল। মানুষ চাইছিল বিকল্প কোনো একজন
নেতা আসুক, যিনি এই অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, ওই সময় মোদি এমন সব আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে মানুষ আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। গুজরাটের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মোদির ভূমিকা ওই সময় খুবই প্রশংসিত হয়েছিল। মানুষ মনে করেছিল, গুজরাট মডেলেই মোদি ভারতকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। এ ছাড়া হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার একটি ধর্মাশ্রয়ী প্রলোভনও কাজ করেছিল। কিন্তু গদিতে বসার পর মোদি আশানুরূপ কাজ করতে পারেননি। অর্থনৈতিক সংস্কার হিসেবে তিনি দুটি কাজ করেছিলেন, যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

২০১৬ সালের নভেম্বরে আচমকা মোদি সরকার ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে এবং ২০১৭ সালে ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স’ নামে নতুন একটি কর আরোপ করে। এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরাও এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এই উদ্যোগ সাংঘাতিকভাবে মোদির জনপ্রিয়তায় আঘাত হানে। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে বলে জোরালোভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

এই অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকতে বিজেপি আবার ধর্মীয় উন্মাদনা সামনে নিয়ে আসছে। তারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বোঝাতে চাইছে তাদের পুনর্বার জয়ী করলে ভারতকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে হিন্দুত্ববাদকেই সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হবে। জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানবিদ্বেষকেও কাজে লাগাচ্ছে তারা। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জনপ্রিয়তা কমেছে বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। খোদ মোদির রাজ্য গুজরাটেই জনপ্রিয়তা কমছে দলটির।

১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ হয়েছিল। এরও এক দশক পর গুজরাটে যে দাঙ্গা হয়, তাতে হিন্দুদের পক্ষে ভূমিকা রেখে মোদি হিন্দুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালে মোজাফফর নগরে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় বিজেপি নেতৃত্ব দিয়েছিল। সে ঘটনাও মোদির ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। সে বিষয়গুলো আবার দৃশ্যপটে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

বাবরি মসজিদের মতো এখন বিজেপি আরও কিছু ঐতিহাসিক মসজিদকে প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের ওপর বানানো মসজিদ বলে দাবি করে সেগুলো ভেঙে ফেলার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। এর মধ্যে মোদির নির্বাচনী এলাকা বারানসির একটি মসজিদও আছে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন শুরুর ঠিক আগে আগে এসব মসজিদ ভাঙার একটা তৎপরতা চালিয়ে হিন্দু ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে বিজেপি। অতিসম্প্রতি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ ফয়েজাবাদ জেলার নাম বদলে ‘শ্রী অযোধ্যা’ রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি হিন্দু ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিজেপি বুঝতে পারছে, ধর্মীয় উন্মাদনা ছাড়া আগামী নির্বাচনে জেতা তার জন্য প্রায় অসম্ভব। সে কারণে তারা সেই উন্মাদনা সর্বোচ্চ মাত্রায় ছড়াতে চাইবে। ভোটে যদি সেই উন্মাদনার জয় হয়, তাহলে উদার গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতের ভবিষ্যৎ মহা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় ভারতের লেখক ও সাংবাদিক