এলএনজি আমদানি নিয়ে শঙ্কা ও করণীয়

গ্যাস সরবরাহে এলএনজিবাহী বিশেষায়িত জাহাজ
গ্যাস সরবরাহে এলএনজিবাহী বিশেষায়িত জাহাজ

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিকে ঘিরে একধরনের শঙ্কা কাজ করছে, বিশেষত ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়বে; বিদ্যুতের দাম, শিল্প উৎপাদন ব্যয়, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। 

প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে। এমনকি ভারতে গ্যাস রপ্তানি করা হবে। টাটাকে শিল্প স্থাপনের জন্য নিবেদিত গ্যাস রিজার্ভ প্রদান করা হবে। এমন পরিস্থিতি থেকে এখন ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ছয়–সাত বছরের মধ্যেই গ্যাসের বিদ্যমান মজুত ফুরিয়ে যাবে। গ্যাস প্রাপ্তির আশায় স্থাপিত শিল্পকারখানায় বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ আটকে আছে। 

কেন এমন হলো?

গ্যাস নিয়ে বর্তমান অবস্থায় আসার কারণ দুটি: ১. অপর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও ২. গ্যাসের সস্তা মূল্য। ১৯৯৮ সালে ২ দশমিক ৫ টিসিএফের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর গত ২০ বছরে আর কোনো উল্লেখযোগ্য গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কেবল ভোলায় ৬০০ থেকে ৭০০ বিসিএফের গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। অথচ একই সময়ে গ্যাসের বার্ষিক ব্যবহার বেড়ে প্রায় ৩ দশমিক ৫ গুণ হয়েছে। ‘সমুদ্র বিজয়ের’ কথা বলা হলেও এর সুফল ঘরে তোলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাগরে মিয়ানমার ও ভারতীয় অংশে গ্যাস পাওয়া গেলেও আমাদের সীমানায় গ্যাস সমীক্ষা ও উত্তোলনের উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

দেশের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত গ্যাসের মূল্যের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। গ্যাসের মতো নিঃশেষযোগ্য পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ হোটেলিং প্রস্তাবিত নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। যেখানে পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক মূল্যের (মারজিনাল কস্ট) সঙ্গে একটি নিঃশেষ অধিহার (ডিপ্লিশন প্রিমিয়াম) যোগ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কেবল উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অর্থনৈতিক মূল্যের চেয়ে কম। ফলে গ্যাসের দক্ষ ব্যবহার বিবেচনায় না নিয়েই যত্রতত্র, এমনকি গৃহস্থালি কাজেও গ্যাস–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। নিম্ন মূল্যের গ্যাসের কারণে অদক্ষ বয়লার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্যাস নিঃশেষ করা হয়েছে। 

এলএনজি আমদানি

এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ৫০০ এমএমসিএফডি পরিমাণ এলএনজি আমদানির জন্য এক্সিলারেটের সঙ্গে চুক্তি করে। ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে আট বছর। অবশেষে গত আগস্ট থেকে গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। চুক্তিতে ৫০০ এমএমসিএফডি থাকলেও ঢাকায় স্থানান্তরের গ্যাস পাইপলাইনের অভাবে ৩০০ থেকে ৩৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস এখন কেবল চট্টগ্রামে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

এলএনজি আমদানির বিভিন্ন পদ্ধতি

সাধারণত স্থলভাগে টার্মিনাল স্থাপন করে এলএনজি আমদানি করা হয়ে থাকে। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এ ব্যবস্থায় উৎস থেকে গ্যাস তরলীকৃত করে জাহাজজাত করা হয়। তা পরিবহন করে আমদানিকারক দেশে স্থাপিত টার্মিনালে মজুত করে পুনরায় গ্যাসে রূপান্তরিত করে লাইনের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এ ধরনের টার্মিনাল নির্মাণে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর সময় লাগে। আরও দ্রুত এলএনজি আনার ব্যবস্থা হলো ভাসমান মজুত ও পুনরায় গ্যাস রূপান্তর ইউনিট (এফএসআরইউ)। অর্থাৎ গ্যাস তরলীকৃত করে জাহাজজাত করে একই জাহাজে তা মজুত ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ হয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় আবার কখনো কখনো পরিবহন ও মজুতকারী জাহাজ (এফএসইউ) থেকে স্থলভাগে স্থাপিত পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর ইউনিটে (আরজিইউ) স্থানান্তর করে সেখান থেকে পাইপলাইনে সরবরাহ হয়। আমাদের চুক্তিটি এফএসআরইউ পদ্ধতিতে এলএনজি গ্যাস আমদানির জন্য করা হয়েছে। 

এলএনজির মূল্য

আমদানি করা এলএনজির মূল্যে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে: ১. তরলীকরণসহ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য; ২. গ্যাস পরিবহনকারী জাহাজের ভাড়া এবং ৩. গ্যাস মজুতকরণ ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর ব্যয়। এখানে দুটি চুক্তি আছে: ১. গ্যাস সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি এবং ২. এফএসআরইউর সঙ্গে চুক্তি। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের মূল্য পরিবর্তনশীল বিধায় প্রাকৃতিক গ্যাস অথবা অপরিশোধিত তেলের মূল্যের সূচকের ভিত্তির ওপর একটি নির্দিষ্ট মারক-আপ যোগ করে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তাই এটা বাজারে দাম ওঠানামার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটি ব্রেন্ট ক্রুডের সূচকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এফএসআরইউর সঙ্গে চুক্তিমূল্যের দুটি বিভাজন রয়েছে: ১. স্থির বা মূলধনী মূল্য এবং ২. পরিচালন মূল্য।

গ্যাস ক্রয় কিংবা এক্সিলারেটের সঙ্গে চুক্তির মূল বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের চুক্তি ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাওয়া যায়। তবে সংবাদপত্রের খবর, বিইআরসির মূল্য নির্ধারণ–সম্পর্কিত আদেশ থেকে পেছনে হিসাব করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এলএনজির ক্রয়মূল্য বেশি। প্রথম চুক্তির অনভিজ্ঞতার কারণেও এটা হতে পারে। বিইআরসির হিসাব অনুযায়ী সঞ্চালন, বিতরণ ব্যয়, ভ্যাটসহ আমদানি করা এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটারে ৩৬ টাকা ১২ পয়সা। দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মেশানোর পর প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য দাঁড়াবে ৮ টাকা ৬৩ পয়সা। বর্তমানে গ্যাসের গড় দাম ৭ টাকা ১৭ পয়সা। বিইআরসির সাম্প্রতিক আদেশে গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রেখে সরকারি বাজেট থেকে ইউনিটপ্রতি ১ টাকা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে ইউনিটপ্রতি ৪৬ পয়সা এবং যথাক্রমে সর্বমোট ৩ হাজার ১৩১ ও ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 

প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব

আপাতত নির্বাচনী বছরে গ্যাসের দাম না বাড়ালেও অদূর ভবিষ্যতে এটা বাড়তে বাধ্য। শিল্পভেদে জ্বালানির ব্যবহার ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ জ্বালানি গ্যাস। তাই গ্যাসের দাম বাড়লে আনুপাতিক হারে বিদ্যুতের দাম বেশি বাড়বে। টেক্সটাইল কারখানাগুলোয় নিজস্ব ব্যবহার্য (ক্যাপটিভ) বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে এবং বয়লারের মাধ্যমে জলীয় বাষ্প তৈরিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস ব্যবহৃত হয়। স্টিল রি-রোলিং কারখানায় তাপ উৎপাদনের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস ব্যবহৃত হয়। তাই গ্যাসের দাম বাড়লে টেক্সটাইল ও স্টিল কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, সিমেন্ট কারখানায় শুধু ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস প্রয়োজন হয়। তাই গ্যাসের দাম বাড়লে সিমেন্ট কারখানার ওপর প্রভাব তুলনামূলক কম পড়বে।

অন্যদিকে, খাদ্যবহির্ভূত খাতের মূল্যস্ফীতির (নন ফুড ইনফ্লেশন) একাংশ জ্বালানি মূল্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই জ্বালানির দাম বাড়লে খাদ্যবহির্ভূত খাতের মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।

জ্বালানির দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে। এর ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। 

অবৈধ সংযোগ ও গ্যাসের কম চাপ

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা ছাড়াও ব্যবসায়ীদের আরেকটি বড় উদ্বেগ আছে। তা হলো চুক্তির তুলনায় গ্যাসের চাপ কম হওয়া। শিল্প এলাকায় অবৈধ সংযোগ দেওয়ার ফলে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে গ্যাসের চাপ কমে যায়। যুক্তরাজ্যের হোপ হাসপাতালের এক গবেষণা অনুযায়ী, গ্যাসের প্রবাহ চাপের বর্গমূলের সমানুপাতে পরিবর্তিত হয়। চাপ কমে গেলে প্রবাহও কমে যায়। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়, বয়লার মৃদু আঁচে চালানো হয়, জেনারেটর তার ক্ষমতার থেকে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অন্যভাবে চিন্তা করলে সঠিক মাত্রায় উৎপাদনের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, চারটি শিল্পকারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, গ্যাসের চাপ কম থাকায় ব্যবহারযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত মূল্য ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। 

করণীয় কী?

ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার কথা ভেবে এখন থেকে পর্যায়ক্রমে আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসসহ সব দেশীয় জ্বালানির অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। আগেই বলেছি, প্রান্তিক উৎপাদন মূল্য ছাড়াও একটি নিঃশেষ অধিহার এর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। দেশীয় রাজস্বের অপ্রতুলতার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে বিশাল ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পর্যায়ক্রমে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে, যাতে করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ের সুযোগ পায়। ভবিষ্যতে এলএনজি আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। কেননা, যত বেশি এলএনজি আমদানি করা হবে, সার্বিকভাবে গ্যাসের মূল্যের ওপর এর প্রভাব বেশি হবে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প মূল্যসূচকগুলো, যেমন: হেনরি হাব, জাপান-কোরিয়া মার্কার, ন্যাশনাল ব্যালেন্সিং পয়েন্ট, জাপান কাস্টম ক্লিয়ার ক্রুড ইত্যাদি বিবেচনা করতে হবে। এ জন্য এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। চুক্তি সম্পাদনের পর এটা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।

এফএসআরইউর পরিবর্তে স্থলভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপনের বিষয় বিবেচনা করতে হবে। অবৈধ গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে, যাতে করে শিল্প খাতের জন্য নির্ধারিত প্রেশারে গ্যাস পেতে পারে। অ্যানালগ মিটারের পরিবর্তে ইভিসি মিটার ব্যবহারের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে।

এলএনজি আমদানির পাশাপাশি সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও দেশীয় কয়লা আহরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বোপরি, জ্বালানিসাশ্রয়ী বিনিয়োগ ও জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ