তারামন বিবিদের আত্মা শান্তি পাক

তারামন বিবি
তারামন বিবি

অনেক দিন আগে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদসহ আমরা কয়েকজন কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানে। কেউ একজন বললেন, এখানে তারামন বিবি এসেছেন। তিনি শ্রোতা-দর্শক সারিতে বসে ছিলেন। আমরা অনুরোধ করি তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসতে। মঞ্চে এসে তিনি আমার পাশে বসেন। অনেকক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনের প্রথম প্রহরেই তারামন বিবি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার ডিসেম্বরের প্রথম দিন মারা যাওয়া অর্থবহ। তিনি যদি একাত্তরের ডিসেম্বরে মারা যেতেন, লাখ লাখ শহীদের মতো আমরা তাঁর নাম জানতাম না। বেঁচে থাকলেও জানতাম না, যদি তিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব না পেতেন। এমনকি খেতাব পাওয়ার পরেও তিনি থাকতেন অজ্ঞাত, যদি না মিডিয়া তাঁকে খুঁজে বের করত।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সবারই শ্রেণিগত অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম শ্রেণির নামজাদা দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে প্রান্তিক দেশপ্রেমিকদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। প্রান্তিকদের খোঁজ রাখা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অপরিহার্য নয়। ব্যক্তি তারামন বিবির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আরও গুরুত্বপূর্ণ তিনি নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি তৃণমূলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তিনি একাধিক শ্রেণির প্রতিনিধি। তারামন বিবি হারিয়েই গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে মফস্বল সাংবাদিকদের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সিকি শতাব্দী পরে ১৯৯৫ সালে তিনি আমাদের চোখে পড়েন।

১৯৯৫ সালে মতিউর রহমান সম্পাদিত ভোরের কাগজ-এ প্রথম তারামন বিবির নাম মুদ্রিত হয়। উত্তরাঞ্চলের সাংবাদিক পরিমল মজুমদারের লেখা প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: ‘বীর প্রতীক খেতাবধারী মহিলা মুক্তিযোদ্ধা তারামনের সন্ধান মিলেছে’। অগ্রজ সাংবাদিক আতাউস সামাদ এই সংবাদটি বিবিসিতেও প্রচার করেন। উবিনীগ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে ফরিদা আখতার এবং ফরহাদ মজহার ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফরিদা আখতার ছুটে যান তারামন বিবির গ্রামের বাড়িতে। আতাউস সামাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর বীর প্রতীক পদক তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তারামন বিবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক ও সনদ গ্রহণ করেন। তাঁকে সম্ভবত ২৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছিল। এই বিত্তবান বাংলাদেশে সেটি ছিল অতি নগণ্য অর্থ।

প্রায় নিঃস্ব তারামন বিবিকে সহায়তা করার জন্য ভোরের কাগজ একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়। আড়াই লাখ টাকা ওঠে। তা দিয়ে তারামন বিবিকে বাড়ি করে দেওয়া হয়। কিছু ফসলি জমিও কিনে দেওয়া হয়। তা ছাড়া, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে তাঁকে সহায়তা দেওয়া হয়। তারামন বিবি অপুষ্টিজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে যেদিন তিনি পদক গ্রহণ করেন, সেদিন সাংবাদিকদের সামনে তারামন বিবি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেছিলেন, সব মুক্তিযোদ্ধাই যাতে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারেন, সরকার যেন তার ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরও বলেছিলেন, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যাঁরা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরা কেউ যেন তাঁর মতো অনাহারে না থাকেন। তাঁর সেই কথা শাসকশ্রেণি এবং সমাজের অধিপতিশ্রেণির কানে প্রবেশ করেছিল, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।

তারামন বিবিকে ১১ নম্বর সেক্টরের সামরিক কর্মকর্তাদের সুপারিশে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৩ সালে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেয়। খেতাব পাওয়ার পর তিনি অপরিচিত ও অজ্ঞাত রইলেন কেন, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রজাতন্ত্রে নেই। তারামন বিবি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে রান্নাবান্না করেছেন। অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা কোথায় আছে, দূর থেকে সে খবর সংগ্রহ করেছেন। জনযুদ্ধে সেই সময় পল্লির এক কিশোরীর সাহস ও দেশপ্রেম আমরা এই সুখের সময় পরিমাপ করতে পারব না।

কুড়িগ্রামের সেই সভায় তারামন বিবিকে কিছু বলার অনুরোধ করা হয়েছিল। আঞ্চলিক বাংলায় তাঁর বক্তৃতায় উচ্চারিত হলো দেশ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি। দেশের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য। তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় দলীয় রাজনীতি ছিল না। ব্যক্তি-বন্দনা গোত্র-বন্দনা ছিল না। নিজের কৃতিত্বের কথা ছিল না। ‘এই করেছি, সেই করেছি’ বলে নিজের বাহাদুরি জাহির করার চেষ্টা ছিল না। দেশ সম্পর্কে তাঁর যে অনুভূতি, তার প্রকাশ ছিল সাবলীল। বোঝা গেল, খ্যাতি তাঁর মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।

পরিবেশদূষণে বাংলাদেশ অদ্বিতীয়। বাঙালির খাদ্যে ভেজাল সহনীয়তার পর্যায় অতিক্রম করেছে। তবে বাঙালির স্মৃতিরোমন্থনের মধ্যে যে পরিমাণ ভেজাল ও মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটে, তা দূষিত খাদ্যের চেয়ে ক্ষতিকর। বাঙালি অন্যের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত। বরং মনে করে, অন্যের প্রশংসা করা আইনত দণ্ডনীয়। আত্মপ্রশংসা ও পরনিন্দায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রান্তীয় যেসব নারী ও পুরুষ মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, তাঁরা অনেকেই স্বীকৃতি পাননি এবং চানওনি। আমার মনে আছে, একাত্তরে নজরুলজয়ন্তীর পরদিন এক মধ্যবয়সী দরিদ্র নারী হরিরামপুরে পদ্মাপারে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর ক্যাম্পে তিনটি বড় মিষ্টিকুমড়া দিয়ে যান। তিনি কে, তাঁর আর কোনো খোঁজ নিইনি।

জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় জনযুদ্ধে মানুষ নানাভাবে অংশগ্রহণ করে। জাতির মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণটাই বড় কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের সবার বীর হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

প্রথম থেকেই আমরা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা করেছি। পিয়ার চাঁন, কাঁকন বিবি, তারামন বিবিদের অনেক দিন পরে আমরা খুঁজে পেয়েছি। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার উদ্যোগে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সমাবেশ হয় ১৯৯০ সালে। ১৯৯৫ সালে শহীদ মিনারে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বড় সমাবেশ হয়। দুর্বল শরীর নিয়ে কবি সুফিয়া কামালও সমাবেশে ছিলেন। তারামন বিবিকেও আনা হয়েছিল। এরপর থেকে তারামন বিবি আলোচনায় ছিলেন, আর অবহেলিত ছিলেন না। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন।

তবে তারামন বিবিদের মতো মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে সেদিন, যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবে অভাব, অবিচার ও অনাচারমুক্ত বাংলাদেশ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক