অরিত্রী ও কৈশোরক আত্মহত্যার দাবানল

অরিত্রী অধিকারী। ফাইল ছবি
অরিত্রী অধিকারী। ফাইল ছবি

‘যদি আসলেই ভালো কিছু করতে চাও, আমাদের অভিভাবকদের জন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করো’—উক্তিটি ছিল এক কানাডীয় মেক্সিকান কিশোরীর।

২০১৬ সালে কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ বিহ্যাভিয়ার’ (কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত আচরণধারা) নামে একটি গবেষণায় জড়িত থেকে অনেকগুলো কেস স্টাডি পর্যালোচনা করতে হয়েছিল। আত্মহত্যার চেষ্টাকারী মেক্সিকান কিশোরীটি বলেছিল, ‘এক ক্লাসমেট প্রতিদিন “ব্যুলি” (গায়ে পড়ে হেনস্তা) করত। সেদিন মার লাগিয়েছিলাম। স্কুলের সালিস, ওয়ার্নিং, কাউন্সেলিং সবই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু স্কুল শেষ হতেই মনে হলো পরের নরকটি আর সামলাতে পারব না। ঘরে ফিরতে না ফিরতেই মায়ের মুখে শুনতে হবে রাজ্যের সব দোষ আমারই। সঙ্গে আরও একগাদা পুরোনো অভিযোগ। তারপর বাপের দোষ, বংশ ও পিতৃপক্ষের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তুলনা। চলবে মা কীভাবে বড় হয়েছে, কী রকম সুবালিকা ছিল, কতটা কৃতিত্বধারী ছিল—সেসব লম্বা ফিরিস্তি। তারপর অন্যদের সন্তানেরা কত ভালো, আমি কত খারাপ, সেই তুলনা। শেষে আমার ভবিষ্যৎ-নির্দেশনা—প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সে যেভাবে চাইবে মানতেই হবে, করতেই হবে—এমন সব জবরদস্তি নির্দেশনা। একসময় বাবা ঘরে ফিরবে। তার সঙ্গে শুরু হবে আরেক দফা অভিযোগ-অনুযোগ–খিটিমিটি। আমার বিষয়ে বাবার অসতর্কতায়, বাবার কারণে কীভাবে রসাতলে যাচ্ছি, সেই ফিরিস্তি। ভাবতে ভাবতে স্পিডে আসা একটি গাড়ির সামনে নেমে গেলাম। গাড়িটি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে সাইডওয়াকে উঠে ইলেকট্রিক পোল ভাঙল। দুমড়েমুচড়ে গেল। প্রতিদিন স্কুল শেষ হলেই বিষণ্নতার ভারে শরীর–মন অবসন্ন হয়ে আসত। রোজ মনে হতো, সামনে দিয়ে যে গাড়িটি বেশি স্পিডে যাচ্ছে, তার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’

বর্ণনাটি মনে দাগ কাটায় আরও ঘাঁটতে গিয়ে এ রকম আরও অন্তত ১০টি কেস স্টাডি পেলাম। বেশির ভাগই অভিবাসী পরিবারের। এই রকম অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শহুরে কিশোর-কিশোরীদেরও নয় কি?

একসময় বাংলাদেশে একান্নবর্তী পরিবারে অনেক আত্মীয়-স্বজন, দাদা-দাদি, নানা-নানি থাকতেন। তাঁরা কিশোর-কিশোরীদের আশ্রয়স্থল—নির্ভরতার জায়গা হতেন। আচরণ ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া শেখার উপায় হতেন। তাঁদের অভিজ্ঞতার গালগল্প-রসিকতা-অভিজ্ঞতা থেকে দুনিয়া চেনার-জানার-শেখার স্বাভাবিক রাস্তা খুঁজে নিত কিশোর-কিশোরীরা। যে পরিবারে দাদা-দাদি বয়সী মুরব্বিস্থানীয়রা থাকতেন, সেখানে নারী-পুরুষ কেউই কোনো বিষয়ে সহজে উচ্চকণ্ঠ বা কলহপ্রবণ হতেন না। মিথস্ক্রিয়াগুলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজটি করত বলে কিশোর-কিশোরীর বয়সকালীন জটিল আবেগাধিক্যও নানাভাবে হালকা হয়ে যেত। বিস্তীর্ণ মাঠে খেলাধুলার সুবিধা, লাইব্রেরি, ধর্মশালা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পারিবারিক পরিবেশ ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের জন্য যে উপকারী ছিল, সেটি বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হতে হয় না।

বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক ‘প্রত্যাশার চাপ’ বেশির ভাগ সময়ই বাস্তবসম্মত নয়। ২০১৫ সালে অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) ৭২টি দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর ‘স্টুডেন্টস ওয়েল-বিইং’ গবেষণাটি করে। গবেষণার ফলাফল এই যে স্কুল-পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা সুখী মনোভাবাপন্ন; তবু তাদের পড়াশোনার ফলাফল নিম্নগামী এবং মনোদৈহিক জীবনমানেরও উত্তরণ ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, পরিবারে ও স্কুলে অত্যধিক ‘প্রত্যাশার চাপ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘মেন্টাল হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৩-২০’–তে কিশোর-কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির ২০১৮ সালের প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, অজন্মগত মানসিক রোগের শুরুটিই হচ্ছে ১৪ বছর বয়স থেকে। জনমিতি বিচারেও বর্তমান সময়ে বিশ্ব-জনসংখ্যায় কিশোর-কিশোরীর সংখ্যাই বেশি। প্রতি ছয়জন মানুষের একজনই ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী। তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্পও হয় না।

বাংলাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন জাতীয় পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর পাস করতে না পারা শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। অরিত্রীর আত্মহত্যার খবরে তাই আমাদের সংবেদনশীল মনে প্রশ্ন জেগেছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মতো একটি শীর্ষ সুনামসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীও আত্মহত্যা করলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই কি বিপন্ন মনে হয় না?

অরিত্রীর শিক্ষকেরা তার সঙ্গে এবং তার বাবার সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করেছেন—শুধু এই অভিমানেই আত্মহত্যা সম্ভব কি না, সেটি খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ! হতেও পারে। যদি কারণ এটিই হয়, তাহলে সেটি দুঃসংবাদের চেয়ে অনেক বড় দুর্যোগ-সংবাদের ইঙ্গিত দেয়। এই সতর্কতাবাণী দেয় যে নিয়ন্ত্রণহীন আবেগপ্রবণ সমস্যায় বিপর্যস্ত কিশোর-কিশোরী আরও অনেক আছে। কৈশোরসঙ্গীদের মধ্যে ‘কপিক্যাট সিনড্রম’ থাকে। একজনের আত্মহত্যা আরও দশটি আত্মহত্যার প্ররোচনা হয়ে উঠতে পারে। কারণ, বয়সজনিত বিশেষ হরমোনের কারণে তাদের জীবনভাবনা, জীবনদর্শন থাকে অগভীর। সেই তুলনায় মনোদৈহিক জটিলতা থাকে অনেক বেশি। তারপরও সময়টি অর্গ্যানিক নয়, মেকানিক্যাল। সবার হাতে হাতে গেজেট। কিশোর-কিশোরীরাই পৃথিবীর ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে বেশি সংযুক্ত। তাদের খবর তাদের নিজস্ব জগতে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন মতে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। শুধু ২০১৬ সালেই ৬২ হাজার কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। তাদের ৯০ শতাংশই উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের। প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘ডিজিটাল মাধ্যমে এই বয়সীদের আত্মহত্যামূলক আচরণের তথ্য আদান-প্রদান একটি উদীয়মান দুশ্চিন্তার বিষয়।’

সমস্যা যখন দেখাই দিয়েছে, বাস্তব সমাধান খোঁজাই বেশি জরুরি। স্কুলশিক্ষকদের দানবীয় আচরণ আগুনে ঘৃতাহুতি হওয়ারই কথা! স্কুল পরিচালনা পর্ষদ রাজনৈতিক ক্ষমতানির্ভর। শিক্ষক নিয়োগও রাজনীতিনির্ভর। স্বভাবতই শিক্ষকেরাও ক্ষমতার রাজনীতির অংশ। সেজন্যই তাঁরাও ক্ষমতার অশ্লীল প্রদর্শনীতে আর লজ্জাবোধ করেন না। রাজনীতি-কলুষিত সব শিক্ষাঙ্গনই আমাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

আমাদের সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সংবেদনশীলতা যেন অর্থহীন না হয়ে পড়ে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষকদের শাস্তির দাবি জানালে বা শাস্তি হলে দেশজুড়ে অন্য শিক্ষকেরা আচরণের বেলায় সংযত হবেন—বিবেচনাবোধের পরিচয় দেবেন বটে; অনেক শিক্ষক একেবারেই নিস্পৃহও হয়ে পড়তে পারেন। ‘গোল্লায় গেলে যাক, যা ইচ্ছা করুক, আমার কী!’

এ ধরনের নির্লিপ্ততা বিপদ না কমিয়ে বাড়াতেও পারে! শেষ বিচারে শিক্ষকেরাই মা–বাবার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিভাবক। ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁদের ভালোবাসা সচরাচর নিজেদের সন্তানের চেয়ে কম না। অরিত্রীর আত্মহত্যা-পরবর্তী জনপ্রতিক্রিয়া আরেকটি সমস্যাকে দৃশ্যমান করে। সেটি হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের বোঝাপড়ার ব্যাপক ফারাক। যেকোনো উপায়ে এই ফারাক দূর করা প্রয়োজন। পরস্পর-মুখোমুখি শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানের বদলে তিন পক্ষের একাত্মতাপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরিতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলে অভিভাবক-শিক্ষক সবার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ভাবনাটিও এখনই শুরু হওয়া প্রয়োজন।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন: রিসার্চ ফেলো, সেন্ট পল’স কলেজ, ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা