শিক্ষার্থী অরিত্রীর আত্মহনন

পাঠদান ও পাস করানোর যে সংকীর্ণ গণ্ডিতে শিক্ষাকে দেখতে সবাই অভ্যস্ত, শিক্ষার মূল চেতনার ব্যাপ্তি তার চেয়ে অনেক বিস্তৃত। শ্রদ্ধার সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছে শিক্ষালাভ করবে—এটিই চিরায়ত বিধান। পাশাপাশি এটিও প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতির অমোচনীয় অংশ যে শ্রদ্ধা স্বয়ম্ভূ নয়, শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়। শ্রদ্ধা একতরফার বিষয় নয়। একজন শিশুশিক্ষার্থীরও যে প্রবল আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে এবং থাকাটাই যে স্বাভাবিক, তা বয়সের দিক থেকে বড় মানুষেরা ভুলে যান। শিক্ষকেরা সেই ‘বড় মানুষদের’ বাইরের কেউ নন। ফলে শিশুশিক্ষার্থীদের ভর্ৎসনা করার আগে তাদের মনস্তত্ত্ব ও আত্মসম্মানবোধের বিষয়টি উপলব্ধি করাকে অনেক শিক্ষকই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য মনে করে থাকেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী ভুল করলে বা ‘অপরাধ’ করলে তাদের অভিভাবকদের তলব করা হবে। এটি আমাদের সমাজে সাধারণ ঘটনা। ওই শিক্ষার্থীর সামনেই তার অসহায় অভিভাবক ‘চোর–ডাকাতের বাবা–মায়ের মতো’ করুণা প্রার্থনার অভিব্যক্তি নিয়ে শিক্ষকদের কৈফিয়ত দিয়ে যাবেন, সেটিও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমরা তা এক রকম মেনেও নিয়েছি। কিন্তু এই ‘সাধারণ’ ঘটনা যে একটি শিশুশিক্ষার্থীর আত্মসম্মানকে কতখানি ‘অসাধারণ’ তিরে বিদ্ধ করে বসতে পারে, তা আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনা।

শিশু অরিত্রীর ভুলের কারণে তার বাবা-মাকে বিদ্যালয়ে তলব করা এবং অরিত্রীর সামনেই তাঁদের সঙ্গে শিক্ষকদের দুর্ব্যবহার করার বিষয়টি ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। অরিত্রী যখন দেখেছে তার ভুলের কারণে তার বাবা–মাকে অপদস্থ হতে হয়েছে, তখন সেই অপরাধবোধ ও অনুশোচনা তাকে করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ জন্য প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্ত তিনজন শিক্ষককে বরখাস্তও করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কোনো টেকসই সমাধান আসবে না। একজন শিক্ষার্থী তার সারা দিনের একটা বড় অংশ বিদ্যালয়ে থাকে। বিদ্যালয়ে অবস্থানের সময় তাদের ভালো–মন্দ শিক্ষকেরাই দেখেন। সে হিসেবে শিক্ষকেরা তাদের অভিভাবকও। এ কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কটিকে কীভাবে কার্যকর ও সচল রাখা যায়, তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা দরকার।

শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, স্বপ্নকে সাকার করার সাহস জোগায়। আত্মসম্মানবোধে ঋদ্ধ না হতে পারলে একজন শিক্ষার্থী স্বপ্নপূরণের সাহস পাবে কীভাবে? সেই সাহস তার মধ্যে তখনই জন্ম নেবে, যখন শিক্ষক ও অভিভাবক তার অহম ও আত্মসম্মানবোধ এবং তার ছোট্ট বুকে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নকে সম্মান করবেন। আমাদের সবার উপলব্ধি করা দরকার যে বিদ্যালয়গুলোতে যে অগণন শিক্ষার্থী আছে, তাদের সবার মধ্যেই আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একেকটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীনচেতা সত্তা আছে। স্কুলে ও বাসায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখতে হবে।