'ভোট কবে কইতে পারি না'

ভোটে নয়, শরিয়তপুর-৩ আসনের নদীভাঙা মানুষের আগ্রহ বাঁধ নির্মাণে। ছবি: লেখক
ভোটে নয়, শরিয়তপুর-৩ আসনের নদীভাঙা মানুষের আগ্রহ বাঁধ নির্মাণে। ছবি: লেখক

বলতে গেলে শরিয়তপুরের তিনটি আসনেই এবার নতুন প্রার্থী। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর (২৩ ডিসেম্বর ২০১১) ২০১২ সালে উপনির্বাচনে ছেলে নাহিম রাজ্জাক সংসদে আসেন। এক অর্থে তাঁর জন্যও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এই প্রথম। এখানে বিএনপির এবারের প্রার্থী তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সচিব মিয়া নাসিরুদ্দিন অপু। শরিয়তপুরের তিনটি আসনের মধ্যে তিন নম্বর আসনের (ডামুড্যা-গোসাইরহাট-ভেদরগঞ্জের একাংশ) হিসাব-নিকাশ একটু জটিল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত হওয়া চারটি নির্বাচনে আবদুর রাজ্জাক নির্বাচিত হলেও তাঁর প্রতিপক্ষের ভোট অন্য দুটি আসনের থেকে এই আসনে ছিল অনেক বেশি।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আবদুর রাজ্জাকের পাওয়া ভোটের হার ছিল যথাক্রমে প্রদত্ত ভোটের ৪৬ শতাংশ আর ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে প্রতিপক্ষের সম্মিলিত প্রদত্ত ভোট ছিল ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে সেটা ছিল ৫১ দশমিক ২ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শতাংশের হিসাবে আওয়ামীবিরোধীদের ভোট একটু কমলেও বিএনপির ভোট প্রায় ৩ শতাংশ বেড়ে যায়। সেবারও জামায়াত আর বিএনপির ভোট একত্র করলে তা আওয়ামী লীগের থেকে বেশি হয় (বিএনপি ৭৭,৩৩৯ ‍+ জামায়াত ৬,০০৫ = ৮৩,৩৪৪ আর আওয়ামী লীগ পায় ৮২,৫৪৩)। জোটের ম্যাজিক বলে কিছু থাকলে তার ছবি এখানে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা তিন আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বলা হয়, এই আসনে আওয়ামী না-পছন্দ ভোটারের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। একাত্তরের মার্চের ৩ তারিখ থেকে সারা দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়লেও গোসাইরহাট এলাকা ছিল ব্যতিক্রম। যুবক-তরুণদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত পতাকা ওড়ে মার্চের শেষ সপ্তাহে।

শরিয়তপুর দুই আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা এনামুল হক শামীম। বিএনপি থেকে লড়বেন শফিকুর রহমান কিরণ। ৯১-এর পর থেকে এ পর্যন্ত সাবেক ডেপুটি স্পিকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৬ নম্বর অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলী নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। ২০০১ ছাড়া সব সময়ই তিনি প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৬০ শতাংশ পেয়েছেন। ২০০১ সালে পেয়েছিলেন প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট। তবে ২০০৮ সালে তাঁর ভোট ২০০১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়লেও প্রতিপক্ষ বিএনপির বাড়ে প্রায় ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। এত ভোট (প্রায় ৮০ হাজার) এই আসনে বিএনপি কখনো পায়নি। এবার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর আশা ছিল, তাঁর ছেলে নির্বাচনের টিকিট পাবেন। সেটা হয়নি। অথচ এ আশায় তিনি বিদেশ থেকে ডাক্তার ছেলেকে দেশে ফিরিয়েও এনেছিলেন।

শরিয়তপুর-১ আসনটিতে বর্তমান সাংসদের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র নিয়ে শুনানি চলছে। ইকবাল হোসেন অপু ৩ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘কেউ কেউ দলের ঐক্য নষ্ট করতে চান। এখনো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করব।’ আসনটি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়। প্রায় ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে আসনটি জিতে নেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সংসদ সদস্য হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গ। সেটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন। তবে তাঁর এই অর্জন এটাও প্রমাণ করে যে মার্কার জাদু সব সময় চলে না। বড়শি মাছ ধরে না, মাছ ধরে শিকারি।

এসব ভাবতে ভাবতে ডামুড্যা তিন খাম্বার মোড়ে যখন থামলাম, তখন সন্ধ্যা। বিকেলের হাটের অবশিষ্ট নিয়ে তখনো চোখ-সওয়া অন্ধকারে বসে আছেন কোনো কোনো কপাল-মন্দ চাষি-গেরস্ত। চায়ের দোকানে মানুষের ভিড় বাড়ছে। হাটুরে হানিফ মণ্ডলের ঝুড়ি থেকে একটা আধপাকা পেঁপে হাতে নিয়ে দামের বদলে প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাই, ‘ভোট কবে?’ আনাজ বিক্রির চিন্তায় ক্লান্ত হানিফ দাম বলেন পেঁপের। গলা চড়িয়ে একই প্রশ্ন করলে হানিফ পেঁপে ফিরিয়ে নেন। মুখে বলেন, ‘কইতে পারি না।’ সকালে নড়িয়ার বাঁশতলা হাটের দোকানি, পদ্মার ভাঙনে সব হারিয়ে রিলিফের তত্ত্বতালাশে ব্যস্ত সাবেক জোতদার কিংবা ভাড়া জমিতে ঘর ওঠাতে ব্যস্ত নদীভাঙা নারী—সবারই মুখে শোনা যায় একই কথা, ‘কইতে পারি না।’

কবে ভোট, কাকে ভোট, কেন ভোট—সবকিছুই যেন দূরের কোনো অদেখা বস্তু—কিছু আসে-যায় না। তবে রাহেলা খাতুন মুলফতগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভাঙা দালানের কাছে পদ্মার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অদেখাকে দেখার জন্য। তিনি খুঁজছিলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভিটার নিশানা। দুবার নদীতে ঘর হারানো সেই নারীও বিশাল পদ্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কইতে পারি না। ঠাওর পাই না কোনখানে জানি ছিল আমাগো ভিটা! মনে অয় অই নৌকার কাছে।’ দূরে আবছা দেখা একটা ডিঙিকে দেখিয়ে বলেন তিনি। পরক্ষণেই মত পাল্টান, ‘না না, আরও আর পেছনে।’

ভাসমান নৌকার কত পেছনে ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া ভিটা কিংবা উৎসবমুখর ভোটকেন্দ্র, তা এখন পদ্মাও বলতে পারবে না। শান্তি-স্বস্তির ভিটা আর উৎসবমুখর ভোটকেন্দ্র, দুটোই কি খুঁজছে মানুষ?

মুলফতগঞ্জের এখনো টিকে থাকা সরকারি-বেসরকারি ইমারতের দেয়ালগুলোয় কেমন জানি ভাসানী ভাসানী গন্ধ। ভাসানী প্রায়ই বলতেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই।’ হাতে লেখা নানা পোস্টারে দেয়ালগুলো ছেয়ে গেছে। সেসব পোস্টার ভোটের আগে নড়িয়া-শরিয়তপুর রক্ষা বাঁধের দাবি জানাচ্ছে। ত্রাণ নয়, ভোটের আগে তাঁরা বাঁধের কাজের শুরুটা অন্তত দেখতে চান। সেটাই এখন এলাকার মুখ্য দাবি। দাবি আরও আছে, আগামী রবিশস্য-চৈতালি ওঠার আগে হাটের জায়গার একটা সুরাহা করতে হবে। বাঁশতলায় হাট বসানোর জায়গা নেই। এখন এক চৌকিতে পুরা সংসারের মতো গুটিসুটি দিয়ে হাট বসছে। শোনা যাচ্ছে, হাট সরে যাবে মুলফতগঞ্জের দিকে। সেখানে কি দোকান বসানোর সুযোগ পাবেন এখানকার মুদি আর আড়তদারেরা?

গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক-গবেষক।