কেন এই দ্বন্দ্ব ও বিভেদ?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

তাবলিগ জামাতের উদ্ভবই হলো ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভীর (র.) প্রচেষ্টায় বিংশ শতকের বিশ দশকের কোনো এক সময় তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয় ভারতের দিল্লির মেওয়াত এলাকায়। বিভিন্ন লেখায় জানা যায়, সেই সময় দিল্লির মেওয়াত এলাকার মুসলিম সমাজের অনেকেই ইসলামের ‘প্রকৃত শিক্ষা’ থেকে দূরে সরে আসে, এমনকি তাদের জীবনাচরণের মধ্যে ধর্মীয় চর্চা নেই বললেই চলে।

এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.)–এর এসব মুসলিমকে ইসলামের চর্চার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তাবলিগের জন্ম হয়। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.)–এর সেই সময়কালের কথা যদি আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, দেখতে পাব যে সেই সময় তাবলিগ নামক ধারণার উপস্থাপনও ছিল ইসলামের মধ্যে একধরনের সংস্কার নিয়ে আসা, যা মোটেও মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর জন্য একটি সহজ কাজ ছিল না। তাই তাঁর সম্পূর্ণ প্রচেষ্টাটাই ছিল সেই সময়ের ইসলাম ধর্মের জন্য একধরনের সংস্কার। প্রায় এক শ বছরের পুরোনো তাবলিগের চর্চার মধ্যে তেমন কোনো সংস্কার প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করিনি বিগত বছরগুলোতে।

আমরা যদি বিশ্ব ইজতেমার কথা বিবেচনা করি, তাহলে বিভিন্ন লেখায় দেখতে পাই, তাবলিগ জামাতের শুরুর পরের দশক থেকেই বার্ষিক ইজতেমা আয়োজিত হয়ে আসছে। তবে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম ইজতেমা আয়োজিত হয় ১৯৫৪ সালে লালবাগ শাহি মসজিদে। ১৯৬৬ সাল থেকে ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আয়োজিত হয়ে আসছে মানুষের ক্রমাগত আগ্রহের কারণে। তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে এ আয়োজন। স্বাধীনতার পরপরই প্রায় ১৬০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় তাবলিগ জামাতের ইজতেমা আয়োজন করার জন্য।

বিশাল এই আয়োজন নিয়ে সমগ্র বিশ্বেই একধরনের অভূতপূর্ব সাড়া দেখা যায়। এই সাড়া কেবল যে তাদের অনুসারীদের মধ্যেই দেখা যায়, সেটা বলা ভুল হবে। পশ্চিমা অনেক গবেষকই এ বিষয় নিয়ে নানা দেশে গবেষণা করে আসছেন দু–তিন দশক ধরে। তাবলিগ জামাতের প্রতি এই বিপুল আগ্রহের কেন্দ্র হলো বিশ্ব ইজতেমায় লাখ লাখ মানুষের জমায়েত বা সম্মিলন। অনেক গবেষক এবং সাধারণ মানুষই অবাক তাবলিগ জামাতের এমন দক্ষতা দেখে, তাবলিগের নেতা এবং সাথিরা কীভাবে এত সুশৃঙ্খলভাবে তাঁদের আয়োজনগুলো করে থাকেন। কোনো ধরনের গোলযোগ ছাড়াই পুরো ইজতেমা সম্পন্ন হয়।

এমন একটি পরিস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের মধ্যে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, সাধারণ মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন জাগায়, তাহলে হঠাৎ করে তাবলিগ জামাতের সাথিরা কেন এতটা সহিংস আচরণ করছেন? তাবলিগ জামাতের মধ্যে কী এমন হলো যে তাদের অনেক সমর্থকই এতটা সহিংস হয়ে উঠলেন? যেখানে তাবলিগ জামাত অহিংস একটি শিক্ষা বিগত বছরগুলোতে দিয়ে আসছে এবং তারা জাগতিক বিষয়ের চেয়ে পরজাগতিক বিষয়গুলো নিয়েই বেশি মনোনিবেশ করে থাকে। ইজতেমায় ঢোকার মুখেই শোনা যেত ‘যঁার যাঁর ডানে চলি, জিকিরের সঙ্গে চলি’। কিংবা কাউকে কাউকে বলতে শোনা যেত, ‘আপনি আগে যান, আমি আপনার পরে যাব’। খেয়াল করলেই দেখা যেত সবাই সুশৃঙ্খলভাবে যাঁর যাঁর ডান দিকে হাঁটছেন। সেই বিশ্ব ইজতেমাতেই গত বছর মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে অংশগ্রহণ করতেও দেওয়া হয়নি। তাঁদের বিভেদ এ বছর এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দুই পক্ষের মধ্যে সহিংস সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এক পক্ষ মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী, আর অন্য পক্ষ মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারী। এ ধরনের ঘটনা কেবল বিশ্ব ইজতেমাই নয়; বরং সামগ্রিকভাবে তাবলিগ জামাতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর ফলে তাবলিগ জামাতের সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে আরও বিভক্তি দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি তাবলিগ জামাতের ‘অরাজনৈতিক’ অবস্থানও প্রশ্নের মুখে পড়বে।

তাবলিগ জামাতের এই বিভেদকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে এই দ্বন্দ্বের মূল কারণকে আদর্শিক একটি জায়গা থেকে দেখা যায়। মাওলানা সাদ কান্ধলভীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য ঘিরেই এর শুরু বলে অনেকে মনে করছেন। কিছু কিছু বিষয় দারুল উলুম দেওবন্দ তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করে এবং তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে। তাঁর বয়ানে উপস্থাপিত কিছু কিছু বিষয় আলেমদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ আসে। যেমন ধর্মীয় শিক্ষা (কোরআন শেখানো ও অন্যান্য) অর্থের বিনিময়ে না করানো; মাদ্রাসার শিক্ষকদের মসজিদে এসে নামাজ পড়া; প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কোরআন বুঝে পাঠ করা ওয়াজিব ইত্যাদি। বলা হয়, এসব বক্তব্যের কারণেই তাবলিগ জামাতের সাদ কান্ধলভীপন্থীদের সঙ্গে আলেমদের বিভেদ শুরু হয়।

মাওলানা ইলিয়াসের সঙ্গে আলেম ও কওমি মাদ্রাসা, বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দের একটি অলিখিত সমঝোতা বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য এক সাল সময় দিয়ে দাওয়াতের কাজ শেখার কথা বলা হতো তাবলিগ জামাতে, অথচ তাদের মধ্যেই আজ বিভেদ। যেখানে তাবলিগ জামাতের উদ্ভবের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল আলেমদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, সেখানে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে বিভক্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো কোনো তাবলিগ জামাতের ‘সাথি’ মনে করেন, এই ক্রান্তিকাল সময়ের ব্যবধানেই সমাধান হয়ে যাবে এবং যাঁরা মাওলানা জুবায়েরের পক্ষ অবলম্বন করছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন সহিংসতা কোনো সমাধান নয়; বরং ধৈর্য ধারণ করে দুই পক্ষের সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব এবং সেটাই করা উচিত। অনেক সাধারণ তাবলিগ জামাতের ‘সাথিরও’ তেমনই মতামত।

এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেন এমনটি হচ্ছে তাবলিগ জামাতের মধ্যে? তাহলে কি তাবলিগ জামাত প্রায় শত বছর পরে একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে তাবলিগ আবার তাদের ‘অহিংস ও অরাজনৈতিক’ আদর্শের দিকে ফিরে আসবে? নাকি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই নতুন বিশ্বে টিকে থাকার জন্য নিজেদের নতুনভাবে মানিয়ে নেবে? সমাজ পরিবর্তনের সামাজিক নিয়ম কিন্তু তা–ই বলে। সময়ের প্রয়োজনেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন মানিয়ে নেয়, তেমনি তাবলিগ জামাতও হয়তো ধর্মীয় পরিমণ্ডলে থেকে আবার নতুন করে বেড়ে উঠবে তাদের অহিংস নীতি নিয়ে। ইজতেমাও আবার বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে সাধারণ মানুষকে তাদের সম্মিলনস্থলে আহ্বান করবে।

বুলবুল সিদ্দিকী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক