কথা দাও, কথাগুলো ফেরত নেবে না

সুবীর নন্দীর কণ্ঠে একটা গান জনপ্রিয় হয়েছিল—কথা দাও, কথাগুলো ফেরত নেবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।’ কথা না দেওয়া যে নিরাপদ, তা আমরা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনপূর্ব ইশতেহার এবং পরবর্তী আচরণ থেকে ঢের জানি। তবু কথা চাই। তবু ইশতেহার চাই।

আমরা আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোটের কাছ থেকে নির্বাচনী অঙ্গীকার চাই। নির্বাচিত হলে আপনারা কে কী করবেন, আমাদের আগে থেকে জানান। আমাদেরও কিছু দাবিদাওয়া আছে। আমরা চাই এই অঙ্গীকারগুলো ভোটের আগেই আপনারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করুন, লিখিতভাবে উপস্থাপন করুন।

বিয়ের আগে সব প্রেমিকই বলে থাকে, ‘তোমাকে আমি চিরজীবন ভালোবাসব। আর কারও পানে চাহিব না আর করিনু এ আমি প্রাণপণ।’ বিয়ের পর এসব কথা লোকে বেমালুম চেপে যায়। কিন্তু তারপরও কি প্রেমিক-প্রেমিকারা এই কথা বলা বন্ধ করেছে? বরং সুবীর নন্দীর মতো গান গেয়েছে—কথা দাও, কথাগুলো ফেরত নেবে না।

আমরাও তেমনি কথা চাই। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত রাখবে কি না, সেটা পরের বিবেচনা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি আমরা চাই। সামনে একটা নির্বাচন। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো যদি নির্বাচনী ইশতেহারে আমাদের আশার কথা না শোনায়, বড় স্বপ্ন না দেখায়, তাহলে তো আমরা জাতি হিসেবে মরমে মরে যাব।

আমরা উভয় জোটের কাছেই এই প্রতিশ্রুতি চাই যে নির্বাচিত হলে নতুন সরকার, নতুন সংসদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করবে। সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের স্তর পর্যন্ত সব জায়গা থেকে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করুক, দলীয় পরিচয় এবং দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্যতা অনুসারে কাজ, টেন্ডার, চাকরি, পদায়ন, মনোনয়ন, পদোন্নতি, নিয়োগ দেওয়া হবে।

সরকারযন্ত্রের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে নিপুণভাবে সম্পন্ন করা হবে, যাতে এগুলোর ব্যয় বেড়ে না যায়; যেন এগুলো জনগণের ওপরে দায় বা দেনা বা বোঝা না হয়ে পড়ে। দ্রুত এগুলোর সেবা জনগণ পেতে শুরু করে। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করুক যে মানবাধিকারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। একজন মানুষও বিনা বিচারে হয়রানির শিকার হবে না; গুম, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ কথাগুলো অতীতের ব্যাপার হয়ে যাবে। সবকিছু চলবে আইনানুগভাবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে।

আমরা চাই, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেবে নির্বাচনী রাজনৈতিক দলগুলো। একজন মানুষও যদি ভিন্ন কথা বলে, তা তাকে বলতে দিতে হবে, সেই কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, আমরা তার কথা মেনে নেব। আমরা এই প্রতিশ্রুতি চাই, কেউ যদি অন্যায্য কথাও বলে, একজনও যদি সে হয়, তাকে সেই কথা বলতে দিতে হবে। এটাই বাক্স্বাধীনতা। সংখ্যাগুরুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা যে কেউ বলতে পারে, ভিন্ন কথা ভিন্নমত প্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই লিটমাস টেস্ট। আমরা প্রতিশ্রুতি চাই যে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।

আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলবে, শিক্ষা যেমন সবার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে, তেমনি শিক্ষার মানও নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করুক, অর্থনৈতিক খাতে নৈরাজ্য বন্ধ করা হবে। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বন্ধ করে আগের লুট হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনা হবে। বিদেশে টাকা অবৈধভাবে পাচার চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে। খেলাপি ঋণ উদ্ধার করা হবে।

মাদক ব্যবসা বাংলাদেশে বন্ধ করা হবে। এর সঙ্গে যুক্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আইনানুগ পথে। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি শত্রুতা নয়—এই পররাষ্ট্রনীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশের মাটি–আকাশ–পানি কোনো দেশের বিরুদ্ধে শত্রুতাসাধনের জন্য অপব্যবহৃত হতে দেওয়া হবে না।

মানবাধিকার রক্ষা করে সব ধরনের উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অটুট রাখা হবে। রাষ্ট্র নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়, নারী-পুরুষ ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনো রকমের বৈষম্য করবে না। সাম্প্রদায়িকতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। ভেদনীতি নয়, ঐক্যের নীতি গ্রহণ করবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকবে।

আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণা করুক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তারা নিশ্চিত করবে। বিচার বিভাগের মর্যাদা তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। আমরা চাই, ইশতেহারে এই কথা থাকুক যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও পদগুলোর মর্যাদা নতুন সরকার রক্ষা করবে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে।

আমরা চাই, ইশতেহারে এই কথা থাকুক যে পরিবেশ রক্ষা হবে নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান করণীয়। আমাদের নদীগুলোকে দূষণ ও দখলমুক্ত করা হবে। আমাদের জলাভূমিগুলো ভরাট করা বন্ধ করা হবে। আমাদের বনসম্পদ রক্ষা করা হবে। আমাদের কলকারখানাগুলো যেন পরিবেশসম্মত হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।

আমরা চাই, ইশতেহারে এই অঙ্গীকার থাকুক, যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত নেওয়া হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করা হবে। শুধু টু পাইস কামানোর চিন্তা না করে জনগণের, দেশের ভালো হয়—এই ধরনের প্রকল্পই গ্রহণ করা হবে। এবং এই প্রকল্পের কাজ তারাই পাবে, যারা এটা সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে ভালোভাবে করে দেবে বলে স্বচ্ছতা এবং নিয়ম দ্বারা প্রমাণিত হবে।

আমরা চাই, নির্বাচনী ইশতেহারে এই অঙ্গীকার থাকুক যে দেশের অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য বিলোপে উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করে পুরো দেশে সমান উন্নয়ন করা হবে। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো কথা দিক যে তারা আমাদের পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করার উদ্যোগ নেবে। রেল ও নৌপথভিত্তিক গণপরিবহনে জোর দেওয়া হবে। যানজট, দুর্ঘটনা রোধে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, মাস্তানি, কোটারি, দুর্নীতি বন্ধ করা হবে।

আমরা চাই, আমাদের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসী জনশক্তির কল্যাণে আমাদের সমুদয় কূটনীতি নিয়োজিত হবে। প্রবাসীদের কল্যাণ, নিরাপত্তা, মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। বাস্তবভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা, বিদেশি ভাষা শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের শ্রমিকদের পেশাজীবীর মর্যাদায় উত্তীর্ণ করার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমরা চাই, আগামী সরকার সংস্কৃতিচর্চায় জোয়ার আনবে। পড়ার বইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীরা যাতে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারে, তার একটা জোয়ার আনা হবে। যেমন নিশ্চিত করা হবে সাক্ষরতা ছাড়াও কম্পিউটার সাক্ষরতা, সবার জন্য। সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য পানি, সবার জন্য খাদ্য, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য বাসস্থান, সবার জন্য কাজ, সবার জন্য মর্যাদা, সবার জন্য বিদ্যুৎ, সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা আগামী সরকার সবাইকে দেবে নিরাপত্তার বোধ। চাঁদাবাজি থাকবে না। লুটতরাজ, দখল-সন্ত্রাস থাকবে না। গুন্ডাতন্ত্র থাকবে না। জুলুম থাকবে না। আসবে সুশাসন, থাকবে আইনের শাসন। প্রতিশোধস্পৃহা থাকবে না। বিরোধী দল ও মত দলন বলে কিছু থাকবে না। গণতন্ত্রকে রক্ষা করা হবে চোখের মণির মতো।

এই কথাগুলো আপনারা বলুন। আমরা নতুন আশায় বুক বেঁধে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার একটা উপলক্ষ চাই। সেই উপলক্ষটা আপনারা আমাদের উপহার দিন। কথা দিন, কথাগুলো ফেরত নেবেন না।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক