বিকল সিস্টেমে অরিত্রীরা কী করবে?

অরিত্রী অধিকারী। ছবি: সংগৃহীত
অরিত্রী অধিকারী। ছবি: সংগৃহীত

বউ-শাশুড়ি সম্পর্কের মিথটা আসলে শুধু ছেলের বউ-বরের মা সম্পর্ক নয়। ‌এটি একধরনের মানসিকতা। এটি একটি রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের মানসকাঠামো। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, কাউকে নিজের কর্মক্ষেত্রে হয়রানির কথা বললে সে জবাব দেবে, ‘আমরাও এভাবেই ক্যারিয়ার গড়েছি, আপনারাও কষ্ট করেই গড়েন।’ কাউকে নিজের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন নিয়ে জানালে খেয়াল করবেন সে বলছে, ‘এসব টানাপোড়েন সব সময়ই ছিল। না ভুগে এগোনো যায় না।’ অর্থাৎ সে যদি তিনি হন, আপনার সিনিয়র হন, আপনার সহযোদ্ধা হন, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে ভোগান্তির বিলোপ না করে পরের মানুষদের জন্য ভোগান্তির পথটুকু একই রকম হাট করে খুলে রাখবেন।

ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের জুতো-ডাল ঘুঁটনি, শিক্ষকের বেতের বাড়ি খেয়ে বড় হয়ে গেলে তখন মার খাওয়ার নাজুকতা না ভেবে পরের প্রজন্মের শিশুদের জন্য মার–দেওয়ার সংস্কৃতিকে যৌক্তিকতা দিয়ে যান অনেকে। ঘটনাগুলোকে দরকারি ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া ভাবলে ভুল হবে কিন্তু। এগুলো নিপীড়িতের মনস্তাত্ত্বিক গণিত। বউ-শাশুড়ি প্রচলিত সম্পর্কের ধারণারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ।

সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনার পরপরই প্রথম প্রথম প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করার উপর্যুপরি লেখাপত্র এলেও হঠাৎ ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। তারপর কে কতভাবে ছোটবেলায় মায়ের ডাল–ঘুঁটনির বাড়ি, টেবিলের তলে মাথা ঢুকিয়ে পেছনে বেতের বাড়ি খেয়েছেন, এ রকম মারধর কতভাবে শারীরিক-মানসিক বিকাশে সহায়তা করে, তার ন্যায্যতা দেওয়া শুরু করেছেন।

এক লেখায় লেখক ‘শাস্তি এমনভাবে দিতে হবে যেন শিশু টের না পায়’–মার্কা বিদ্রূপাত্মক লাইন লিখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, পাশ্চাত্যের ধরনে বাচ্চা ‘মানুষ’ করা কত বড় ভুল। ‘এই ঠগ–বাটপারের দেশে তুলুতুলু বাচ্চা টিকবে কীভাবে, সেই চিন্তা নাই’! তো, এ কথা মেনে নিলে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক যুদ্ধের সময় ছোট ছোট শিশুর মধ্যে ‘যুদ্ধ মানুষকে সভ্য করে, শান্তি মানুষকে অমানুষ করে দেয়’ ধরনের প্রচারণাকে বৈধতা দিতে হবে। যুদ্ধবাজ দেশের শিশুদের তার মানে শৈশব থেকেই বন্দুক-শটগান তুলে দেওয়াকে যৌক্তিক বলতে হবে।

লেখক ওপরে বলা লক্ষণে আক্রান্ত হয়ে ভুলেই গেছেন শিশুরা আসলে প্রাপ্তবয়স্ক নয়; বরং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে স্পর্শকাতর। তাদের অপমান করার আগে আপনি শিক্ষক হলে ভাবতে হবে, এই অপমানটার প্রভাব তার মনস্তত্ত্বে কেমনভাবে পড়তে পারে। তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কী কী ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যের দেশে নকল ও নিয়ম ভঙ্গের কড়া শাস্তির কথা এক লেখক উল্লেখ করলেও তিনি একবারও কোথাও উল্লেখ করেননি যে সেসব সভ্য দেশে প্রায় প্রতিটি স্কুলেই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। কেউ কোনো অনিয়ম করলে, পড়াশোনায় অমনোযোগী হলে, ক্রমাগত নিয়ম ভঙ্গ করলে তার নেথ্যের কারণ খতিয়ে দেখে তার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যেকোনো মানসিক সমস্যায় বিনা মূল্যে কাউন্সেলিং নিতে পারেন। এমনকি নেহাত রাস্তায় কেউ যদি এমন কোনো আচরণ করে, যেটাতে মনে হয় ব্যক্তিটি কোনো কারণে সমস্যা অনুভব করছে তো পুলিশ সবার আগে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মধ্যে কোনো সেলফ হার্মিংয়ের চিন্তা আছে?’

প্রায় প্রতি সেমিস্টারে সেখানে একধরনের অনলাইন কোর্স করা বাধ্যতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় তারা যেন কখনো চুপ করে না থাকে, যেন অভিযোগ জানায়। যৌন হয়রানি হলে যেন যথাযথ জায়গায় অভিযোগ করে। কোর্সগুলো না করলে সেমিস্টারের শর্ত পূরণ হয় না।

কিন্তু আমরা যেহেতু ডাল–ঘুঁটনি, জুতো-হ্যাঙারের বাড়ি খাওয়া মনস্তত্ত্বের অধিকারী, তাই আমাদের কাছে কাউন্সেলিংয়ের চেয়েও টিসি ও বেতের বাড়ি অধিক গ্রহণযোগ্য। আমাদের কাছে ‘আমি খুন্তির ছ্যাঁকা খাইয়া বড় হইছি, তুই খাবি না মানে’ ও ‘আমার দাদির ৩২টা বাচ্চা হইছে গোয়ালঘরে আর তুই হাসপাতালে যাবি মানে’ ধরনের যুক্তিই জনপ্রিয়।

অথচ প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, কোনো শিক্ষার্থী যদি নকল করে, তাহলে তার নকলের মনস্তত্ত্ব খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে কি না। প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, শিক্ষার্থীকে ক্লাসে মোবাইল ফোন আনার জন্য আগে কতবার সতর্ক করা হয়েছে। নকল যদি করেই থাকে, তাহলে টিসি দিলেই কি তার সমাধান হয়? এমনকি টিসি দিয়ে দিলে সেই শিক্ষার্থীর নৈতিক অধঃপতনের দায় শিক্ষকেরা এড়াতে পারেন কি না? টিসি দিয়ে দিলে সেই শিক্ষার্থী অন্য কোনো স্কুলে গিয়ে একই কাজ যদি করে, তাহলে কি টিসির দুষ্টুচক্রে আটকে যাবে কি না। প্রশ্ন তো হওয়া উচিত ছিল অরিত্রী কি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, নাকি গোটা দেশের? ভিকারুননিসা বা রাজউক বা ল্যাবরেটরি বা বাঙ্গাবাড়ী স্কুল কি আলাদা ভূখণ্ড? সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কি কেবল ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক? তাঁরা কি কেবল ওই প্রতিষ্ঠানেরই মেরুদণ্ড? তাহলে জাতির মেরুদণ্ড কে বা কারা?

অনেককেই দেখলাম শিক্ষকদের না দুষে পিতা-মাতাকে দুষতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাহলে আবার প্রশ্ন আসে, পিতা–মাতার মনস্তত্ত্ব কে বা কারা ঠিক করে দিয়েছেন? সন্তান পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ না পেলে প্রাইভেটে পড়ার পয়সা কি সরকার ভর্তুকি দেয়? সন্তানের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্যায় জেনেও লাখ লাখ টাকার ভর্তি–বাণিজ্য, কোচিং–বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে পিতা–মাতার আয়ের পিণ্ডি চটকানোর দায় ঠিক কার? যে ঘটনা রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক জানে, সেই ঘটনা রাষ্ট্র জানে না কেন? রাষ্ট্র জানলে তার প্রতিষেধক দেওয়া হয় না কেন? তার মানে কি এই সব ভর্তি-বাণিজ্য, টিসি-বাণিজ্য, কোচিং-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস একই সুতোয় গেঁথে অরিত্রীদের গলায় পরানো হচ্ছে কি না—তার উত্তর কে বা কারা দেবেন? শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করলে রাষ্ট্রের পেটে বাড়তে থাকা একটা সাব-রাষ্ট্র থেকে আরেকটা সাব-রাষ্ট্রে টিসির আঠায় অরিত্রীদের বেঁধে চালাচালি করলে কারা লাভবান হন? প্রতিবার হাজার হাজার টাকার ভর্তি ফিতে কারা উপকৃত হন? এই সব নিয়মনীতি ঠিক কারা বানান, কারা মেনে চলেন এবং কাদের জন্য টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন—কেউ কি উত্তর দেবেন? না দেন উত্তর, প্রশ্নগুলো একত্র করে অন্তত ভাবেন একবার।

অরিত্রীর মৃত্যু তাই ব্যক্তির মৃত্যু নয়। অরিত্রী মরে গিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সিস্টেম কতখানি বিকল হয়ে আছে। যেকোনো সময় সিস্টেমের বিভ্রাটে কেউ সিলিংয়ে ঝুলে পড়তে পারে। তবুও এই সিস্টেম মেরামতের প্রেষণা কতজনের ভেতর কাজ করে? প্রত্যেকেই যে যার মতো করে বিকল হয়ে থাকতে থাকতে বয়স বাড়িয়ে একদিন মরে যাচ্ছে। কারোর ফাঁসির প্রয়োজন নেই, কাউকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন নেই, কারও আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করারও প্রাসঙ্গিকতা নেই; দরকার একটা প্রজন্ম তথা একটা সিস্টেমের সংস্কার। সবাই বাঁচুক আর সবাই বাঁচাক। এমনকি বউ-শাশুড়ি মিথ মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে, সবাই যে যার মতো হাত লাগিয়ে সিস্টেমের সংস্কারকাজে মন দিক।

বীথি সপ্তর্ষি: সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]