ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বেলুন যেভাবে ফাটল

ফরাসি বিক্ষোভকারীদের ভয়ে সরকার জ্বালানির ওপর থেকে সব কর তুলে নিলেও জনতা চাইছে সরকারের পরিবর্তন। ছবি: এএফপি
ফরাসি বিক্ষোভকারীদের ভয়ে সরকার জ্বালানির ওপর থেকে সব কর তুলে নিলেও জনতা চাইছে সরকারের পরিবর্তন। ছবি: এএফপি

সম্প্রতি ফরাসি সরকার কর্তৃক ডিজেল ও পেট্রলের ওপর বাড়তি কর বৃদ্ধির ঘোষণার বিরুদ্ধে গত নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে ফ্রান্সব্যাপী সব শ্রেণির এবং বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নাগরিকদের ভেতর অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। দ্রুত এক অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলন দেশটার প্রান্তিক মানুষকে জড়িয়ে ফেলে। এই গণ-আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা শুধু ফ্রান্সের তথাকথিত এলিট ও ধনীদের প্রেসিডেন্ট বলে অভিহিত এমানুয়েল মাখোঁ ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যেরই নয়, বরং গোটা ফরাসি কায়েমি ব্যবস্থাকেই হকচকিত করে দিয়েছে। সম্প্রতি তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী বেলজিয়ামেও।

কারা আসলে এই আন্দোলনকারী? বিক্ষোভকারীরা প্রধানত গোটা ফ্রান্সের প্রান্তিক টাউন, শহর ও গ্রামাঞ্চল থেকে আসা পেশাজীবী সাদা পুরুষ, নারী ও সিঙ্গেল মাতা। তাঁদের অধিকাংশ কর্মজীবী—যেমন: সেক্রেটারি, আইটি কর্মী, ফ্যাক্টরি কর্মী, সরবরাহ ও স্বাস্থ্য খাতে কাজ করা নারী–পুরুষ। পেনশনধারীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। সবাই স্বল্প বেতনের হওয়ায় দ্রব্যমূল্য এবং কর বৃদ্ধির ফলে মাসের শেষে টানাটানির মধ্যে নিমজ্জিত।

এই আন্দোলনকে ‘gilets jaunes’ বা ‘হলুদ জ্যাকেট’ নাম দেওয়ার কারণ, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকেই জ্বলজ্বলে হলুদ জ্যাকেট—যা আইনত প্রত্যেক ফরাসি গাড়িচালককে গাড়িতে রাখতে হয়—পরেই আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলন প্রথমে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে শুরু হলেও দ্রুতই তা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা একে ১৯৬৮ সালের অভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

কোনো রাজনৈতিক দল বা ট্রেড ইউনিয়ন এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আন্দোলন ছড়িয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনলাইন পিটিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রমিকদের করা ভিডিও পোস্টের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনের কোনো ঘোষিত নেতা বা নেত্রী নেই। তৃণমূল অ্যাকটিভিস্টরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আন্দোলনকে জড়াতে রাজি না। এতে বোঝা যায়, ফ্রান্সের প্রচলিত রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের ওপর আন্দোলনকারীদের ন্যূনতম আস্থা নেই। ফেসবুক, টুইটার, অনলাইনে ভিডিও পোস্টের প্রাধান্য থেকে বোঝা যায়, মিডিয়ার প্রতিও তাদের আস্থা নেই।

জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কারণ কিন্তু বিশ্বায়িত নতুন অর্থনৈতিক মডেলের ব্যর্থতা নয়, বরং এর সাফল্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমেরিকা, জার্মানির মতো ফরাসি অর্থনীতিও প্রচুর সম্পদ সৃষ্টি করেছে। ফরাসি ধনীদের সম্পদ বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে এখানে বেকারত্ব, সামাজিক অনিরাপত্তা ও দারিদ্র্য ব্যাপক বেড়েছে। ফলে, এসব দেশে এক নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভৌগোলিক এলাকা বিভাজিত হয়েছে। শিল্পকারখানার বদলে সেবামূলক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। কর্মসংস্থান এবং সম্পদ বেশি হারে মেট্রোপলিটন শহরগুলোয় ঘনীভূত হয়েছে। ফ্রান্সের যেখানে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে পড়ছে, এমন সব অঞ্চল, ছোট ও মধ্যম আকারের শহর এবং গ্রামাঞ্চল ক্রমান্বয়ে গতিশীলতা হারিয়েছে। এসব অঞ্চলে এখন আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না। প্রান্তিক ফরাসিদের সঙ্গে মেট্রোপলিটন ফ্রান্সের বৈষম্য যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে অসন্তোষ, ক্ষোভ, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব।

রাজনীতিবিদেরা বিশ্ব পুঁজিবাদী এলিটদের স্বার্থ রাখাকেই প্রাধান্য দিতে থাকলেন। মাখোঁ ক্ষমতায় এসেছেন প্রতারণার মাধ্যমে। ফরাসি জনগণ তাঁর গালভরা বুলি বিশ্বাস করেনি। কারণ, মাখোঁ অবশ্যই সেই এলিট সমাজেরই অংশ, যারা সমস্যার জন্য দায়ী। অন্য জনপ্রিয় ফরাসি রক্ষণশীল প্রার্থীকে এলিট নিয়ন্ত্রিত ফরাসি মিডিয়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে তাঁকে নির্বাচন থেকেই সরিয়ে দিয়েছিল। অন্য প্রার্থী মারিন লে পেনকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে এবং সর্বক্ষণ মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে কলঙ্কলেপন করা হতে থাকে। সে কারণেই দক্ষিণপন্থী নেত্রী মারিন ল পেনকে ঠেকাতে মাখোঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনা ছাড়া ফরাসি জনগণের উপায় ছিল না।

২০১৬ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যেই সংস্কারের নামে পেনশনের আয় কমিয়ে দেওয়া, রেলকর্মীদের অবসরের বয়স বাড়ানো, আরও বেশি করারোপ, ব্যয় সংকোচন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাপক চাকরিচ্যুতি, গণছাঁটাই, শ্রমিক ও চাকরিজীবীদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কেটে নেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের মহার্ঘ ভাতা কেটে নেওয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নির্বিচারে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির জোরে বিভিন্ন অজনপ্রিয় শ্রম আইন, পেনশন হ্রাস, নতুন করারোপ করে যাচ্ছিলেন।

চলমান বিক্ষোভ প্রাথমিকভাবে যদিও অন্যায্য করব্যবস্থার বিরুদ্ধে, তা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা এই অবস্থার আশু পরিবর্তন চায়। বলা বাহুল্য, হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে ফ্রান্সব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। ১ ডিসেম্বরের সহিংসতা ফ্রান্সের গত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল।

প্রতিক্রিয়ায় ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এদুয়া ফিলিপ টেলিভিশনে সব ধরনের জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। স্বঘোষিত দৃঢচেতা মাখোঁ এত সহজে পিছুটান দিয়ে বসলেন? অধিকাংশ বিক্ষোভকারী এবং ফরাসি জনগণ এখন গোটা ফরাসি সমাজের পরিবর্তনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। তাঁরা এখন সরকার পরিবর্তন চাইছেন। পরিস্থিতি দেখে জ্বালানির ওপর সব ট্যাক্স একবারেই বিলোপ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এদুয়া ফিলিপ। এই ঘোষণায় বিদ্রোহের যে দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তা কি আবার বোতলে ফিরে যাবে? শুধু এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও এলিটদের জন্য দীর্ঘ এবং কঠিন অপেক্ষা করছে।

মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মডেলের দ্বারা সামাজিক বঞ্চনা ও অসন্তোষ ব্যাপকতা পাচ্ছে, সেখানে কত দিন সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে? পাশ্চাত্যের অগ্রসর অর্থনীতির দেশেই যদি এই অবস্থা চলে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অবস্থা তাহলে কতটা ভয়াবহ?

লেখক: নেদারল্যান্ডসে বাসকারী অ্যাকটিভিস্ট।