ইসির যে ধন্যবাদ প্রাপ্য

আসিফ নজরুল ও  প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। ফাইল ছবি
আসিফ নজরুল ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। ফাইল ছবি

নির্বাচন কমিশনের কাজ এবার প্রথম থেকেই ছিল দুরূহ। নির্বাচনকালে অপরিবর্তিত দলীয় সরকার, বহাল থাকা সংসদ, ১০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন একটি দলের ছায়ায় কমিশনকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার সাংবিধানিক ম্যান্ডেট কমিশনের ছিল। দেশের সংবিধান অনুসারে নির্বাচনকালে কমিশনের ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ।

কিন্তু সূচনা থেকেই এর কিছু ব্যত্যয় ছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন-মিছিলে বাধা না দিয়ে কয়েক দিন পর বিএনপির প্রার্থীরা তা শুরু করামাত্র পুলিশকে তা বন্ধ করতে বলে কমিশন প্রথমে সমালোচিত হয়। এরপর রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা পদে কমিশন নিজের কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দিয়ে এবং ইভিএম ও নির্বাচনকালে সেনা নিয়োগ প্রশ্নে সরকারি দলের মতো অবস্থান নিয়ে আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে এর বিপরীতে কিছু অন্য চিত্রও ছিল। বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে তাঁর দলের মনোনয়নে ভূমিকা রাখতে দিতে বাদ সেধেছিল আওয়ামী লীগ। কমিশন এ বিষয়ে হস্তক্ষেপে অপারগতা প্রকাশ করে তার স্বাধীন সত্তার পরিচয় রাখে।

এই সত্তার প্রকাশ আরও জরুরি হয়ে পড়েছিল নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল প্রক্রিয়ায়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে সাধারণত দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তাঁরাই যখন এবারও রিটার্নিং কর্মকর্তা হলেন এবং এ কারণে মনোনয়ন বাছাইয়ের দায়িত্ব পেলেন, তখন তা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়।

রিটার্নিং কর্মকর্তারা এই শঙ্কা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁরা তুচ্ছ কারণে কয়েকটি আসনে বিএনপিকে প্রার্থীশূন্য করে দেন এবং অর্ধশতাধিক আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেন। অন্যদিকে দু-একটি বাদে আওয়ামী লীগের কেবল বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়।

আপিল প্রক্রিয়ায় কমিশন সে সংকট আপাতত দূর করেছে। বিএনপির কমপক্ষে ৭০ জন প্রার্থীসহ আরও অনেকের মনোনয়ন বৈধ করে নির্বাচনকে অংশগ্রহণ-মূলক করার একটি বড় শর্ত তারা পূরণ করেছে। খালেদা জিয়ার মনোনয়ন বাতিলসহ কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ আছে, আছে কিছু বিতর্ক। তবে সার্বিকভাবে কমিশন আপিল নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে।

কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দসই প্রার্থীদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছে। এখন নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের অবাধ ও সুষম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই নির্বাচনী প্রচারণাকালে পুলিশি হয়রানি থেকে তাঁদের রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে। গায়েবি মামলা, ঢালাও গ্রেপ্তার আর তল্লাশির আতঙ্কে সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-কর্মীরা এলাকাছাড়া থাকলে তাঁরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাবেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের সমর্থকেরা বিশ্বাস করতে পারবেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে? এ বিশ্বাস না এলে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সাহস ও উদ্যম তাঁরা পাবেন কীভাবে?

নির্বাচন কমিশন চাইলে পুলিশ-প্রশাসনে রদবদল এনে, রাজনৈতিক মামলাগুলো স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে এবং ঢালাও গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক থেকে পুলিশি হয়রানি বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, নির্বাচন পর্যন্ত বৈধ অস্ত্র জমাদান, সরকারি প্রচারযন্ত্র ব্যবহারে সব দলকে সমান সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সরকারকে কমিশন নির্দেশ দিতে পারে। যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়ন বাছাইয়ের সময় পক্ষপাত দেখিয়েছেন, তাঁদের এবং কিছু সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা পদে কমিশন নিজেদের কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও ভাবতে পারে।

সবশেষে ধন্যবাদ জানাই নির্বাচন কমিশনকে। মনোনয়ন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় তারা কিছুটা হলেও আস্থা জাগিয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়