ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতায় আন্দোলন জরুরি?

রানা প্লাজার ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) জীবন ও মৃত্যুর বিষয় হতে পারে।
রানা প্লাজার ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) জীবন ও মৃত্যুর বিষয় হতে পারে।

যখন আপনি কোনো পণ্য কেনেন, আমার ধারণা, আপনি আশা করেন, মানবাধিকার আইন মেনেই পণ্যটি তৈরি হয়েছে। আপনি আশা করেন, উৎপাদনে কোনো অন্যায্য মজুরি প্রদান হয়নি, মানব পাচার, বা জোর করে শিশুশ্রম আদায়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। হয়নি কোনো বৈষম্য–নিপীড়ন বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত। সম্ভবত আপনি আরও আশা করেন, পণ্য তৈরিতে উৎপাদনকারী সংস্থা পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতে সচেতন ছিল।

বাস্তবতা হলো বেশির ভাগ পণ্যই কলকারখানায় এমন অবস্থায় তৈরি হয়, যা মানবিকতা ও পরিবেশ সংরক্ষণ থেকে অনেক দূরে। অনেক ক্ষেত্রে পণ্য তৈরির উপায় সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানতে পারি অথবা আমরা জানতে আগ্রহ বোধ করি না। ভাবুন তো, আপনার পরিহিত জামাটি যিনি বানিয়েছেন, এটি বানাতে কি তিনি মজুরি পেয়েছেন? মাতৃত্বকালীন ছুটি অথবা শারীরিক বা মৌখিকভাবে কোনো নির্যাতনের স্বীকার হননি তো তিনি?

অনেক সময় এই অসংগতি ভয়াবহ বিপর্যয় আনে। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ছিল তেমনই একটি ভয়াবহ বিপর্যয়। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১০০–এর বেশি মানুষ নিহত হন। এই মানুষগুলো রানা প্লাজায় অবস্থিত তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় কাজ করতেন। শুধু দাসত্ব অথবা জোর করে ফ্যাক্টরিতে আটকিয়ে রাখার ফলে এতজন শ্রমিক প্রাণ দেন। ইন্ডিটেক্স, ম্যাঙ্গো, লবল, প্রাইমার্ক, ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানিগুলোর পণ্য তৈরি হতো এসব কারখানায়। এমন একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) জীবন ও মৃত্যুর বিষয় হতে পারে।

ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণাটি নতুন নয়। বহু বছর আগে থেকেই এই ধারণা এসেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মানুষের অধিকার ও পরিবেশের বিষয়টিতে সচেতন থাকতে হবে। সম্প্রতি এটির বেশি ব্যবহার দেখা যায়। নব্বইয়ের দশকে সিএসআর শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে, যখন বৈশ্বিক খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী কোম্পানি নাইকিকে পোশাক সরবরাহ শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদনকারী সোয়েটশপস। ঘটনাটি ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজের মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে গবেষণা প্রায় ১২ বছর। এই গবেষণায় আমি দেখেছি, ২০ বছর আগের বিশ্লেষকেরা সামাজিক দায়বদ্ধতার এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করতেন, এটি একধরনের স্বনিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে করপোরেশনগুলো স্বেচ্ছায় এমনভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবে, যেখানে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ, নৈতিকতা ও পরিবেশের যত্নের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। তবে সম্প্রতি এই বিশ্লেষকেরাই দেখেন, আইন ব্যবস্থার কোনো চাপ না থাকলে কোম্পানিগুলোর কেবল তখনই বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতা দেখায়, যখন তারা রানা প্লাজার মতো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় এবং যখন গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সামাজিক আন্দোলনের ব্যাপক চাপে পড়ে। সরকারি আইনের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার কার্যক্রম নিয়মিত হয় না। তবে গত দশক থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার কিছু ক্ষেত্রে একটি আইনগত বাধ্যতামূলক করপোরেট কার্যক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে।

সারা বিশ্বেই নতুন ধরনের আইন নিয়ে কথা হচ্ছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় নতুন আইন চালু হয়েছে। ২০১০ সালের ক্যালিফোর্নিয়া ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট (সিটিএসসিএ), ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের মডার্ন স্লেভারি অ্যাক্ট এবং ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়ার মডার্ন স্লেভারি অ্যাক্ট অনুযায়ী কোম্পানিগুলোকে তাদের পুরো উৎপাদনব্যবস্থায় আধুনিক দাসত্ব, শিশুশ্রম, মানব পাচার মোকাবিলার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা প্রকাশ করতে হবে। এই কার্যক্রম কেবল বিশ্বের উন্নত দেশের জন্যই প্রযোজ্য নয়,কিছু উন্নয়নশীল দেশও এটা নিয়ে চিন্তা করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও এই কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে। ২০১৩ সালে সেকশন ১৩৫ অব দ্য ইন্ডিয়ান কোম্পানিজ অ্যাক্টে বলা হয়, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই তাদের কর–পূর্ববর্তী মুনাফার ২ শতাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের এই নতুন অবস্থা করপোরেশন আইনে একটি বড় পরিবর্তন আনে। এই প্রথম কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের কাছে প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক, কিছু নির্দিষ্ট বিষয় প্রকাশ করার বিষয়টি উঠে আসে। এর প্রধান লক্ষ হলো মানবাধিকার ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ে একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর কাছে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়ানো। আরও বলা যায়, কোম্পানিগুলো শুধু দেশের ভেতরের আধুনিক দাসত্ব বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান করার জন্য পদক্ষেপ নেবে না, বরং যেসব উন্নয়নশীল দেশে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম আছে, সেখানেও যেন এই বিষয়গুলো মানা হয়, তাও তাদের দেখতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা বেশি গুরুত্ব পাবে। রানা প্লাজার মতো ভবনে উৎপাদন কার্যক্রম চালানো যাবে না।

যেহেতু বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলোকে কিছু পরিমাণ সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এ রকম বাধ্যতামূলক সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম কি সঠিকভাবে কাজ করছে?

বিষয়টি নিয়ে আমার গবেষণার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রত্যাশিত করপোরেট সামাজিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি আসবে কি না, তা নিয়ে আমি আমার আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডের সহকর্মীদের সঙ্গে গবেষণা করেছি। আন্তর্জাতিক এই গবেষণার দল নিয়ে প্রথমে আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট (সিটিএসসিএ) নিয়ে তদন্ত করি। সিটিএসসিএর তালিকাভুক্ত ১০৫টি প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা করে আমরা দেখতে পাই, আইন কার্যক্রমের প্রথম বছর ৮৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দাসত্ব এবং মানব পাচার নির্মূল করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা প্রকাশ করেছে। তবে খুব বিস্তারিতভাবে কার্যক্রমের বিষয়টি প্রকাশ করেনি তারা। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রকাশ বেশ সীমিত ছিল। পাঁচটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছিল, মাত্র ৪ শতাংশ কোম্পানি তা পুরোপুরি প্রকাশ করে। আসলে বৃহত্তর করপোরেট স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এরপরে আমরা ডড ফ্রাংক অ্যাক্টের কনফ্লিক্ট মিনারেল রুলের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করি। আমরা বিশ্বব্যাপী কয়েকটি ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির দিকে নজর দিই। এই কোম্পানিগুলো প্রায় ২০ দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন করে। আমরা দেখতে পাই, কনফ্লিক্ট মিনারেল অ্যাক্ট অনুযায়ী তারা ব্যাপকভাবে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম প্রকাশ করছে না। কিন্তু আমরা লক্ষ করলাম, প্রতিষ্ঠানগুলো এনজিও সহযোগিতা এবং সুশীল সমাজের বিক্ষোভের কারণে আরও ব্যাপক এবং আরও স্বচ্ছ, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম প্রকাশের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের এই গবেষণায় যা দেখা গেছে, তা হলো এনজিওদের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির কারণেই করপোরেট জগতে স্বচ্ছতার উন্নয়ন হয়েছে। তার মানে এই দাঁড়ায়, শুধু আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপক হারে কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পায় না, এর জন্য দরকার ‍সামাজিক ও সুশীল সমাজের আন্দোলন এবং এনজিওর সক্রিয়তা। অর্থাৎ আইনের সঙ্গে সঙ্গে সুশীল সমাজ এবং এনজিওর সক্রিয়তা ও পর্যবেক্ষণ কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমকে ভালোভাবে চলমান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের এই গবেষণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সুশীল সমাজ ও এনজিওর আন্দোলন কেবল সরকারকে সামাজিক দায়বদ্ধতা আইন করতে বাধ্য করবে না, সেই সঙ্গে তারা কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম মনিটরিংও করতে পারবে। যেটা আসলে দরকার, সেটা হলো আমাদের সুশীল সমাজকে এমনভাবে ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়তা করে।

ড. এম আজিজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও গবেষক, অ্যাকাউন্ট্যান্সি বিভাগ এবং বিজনেস স্কুল লিড রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন প্রধান, ইউনিভার্সিটি অব এবারডিন, স্কটল্যান্ড
[email protected]