খালেদা জিয়ার ভাগ্য ঝুলে আছে তৃতীয় বেঞ্চে

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনী ভাগ্য এখন তৃতীয় বেঞ্চে ঝুলন্ত। ‘তিন আসনে প্রার্থিতা ফিরে পেতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করা রিটে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এই বিভক্ত আদেশ হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি খালেদা জিয়ার আপিল গ্রহণের পক্ষে মত দেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. ইকবাল কবির গ্রহণের পক্ষে ছিলেন না।

আইনজীবীরা বলেছেন, এখন বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আরেকটি বেঞ্চে পাঠাবেন। এটি তৃতীয় বেঞ্চ হিসেবে পরিচিত।’ 
এক বা একাধিক বিচারপতির সমন্বয়ে প্রধান বিচারপতি তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করে দিতে পারেন। বেঞ্চ গঠনের ব্যাপারে প্রচলিত আইনে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। তবে প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ হলো, নথি পাওয়ার পরই প্রধান বিচারপতি এক সদস্যবিশিষ্ট তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করে দেন। কিন্তু কত দিনের মধ্যে তৃতীয় বেঞ্চ নিষ্পত্তি করবেন, সে বিষয়ে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় না। তৃতীয় বেঞ্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন।

তবে কোনো রিট দায়েরের পর রুল জারি এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারির পর্যায়ে বিভক্ত আদেশ প্রদানের রেওয়াজ বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের এক চলতি প্রবণতা। ক্রমেই এই ধারার বিস্তৃতি ঘটছে এবং তৃতীয় বেঞ্চে সাধারণত কনিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের সমর্থনে সিদ্ধান্ত এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

আরও একটি ধারা হলো সংক্ষুব্ধ রিট আবেদনকারী যে প্রতিকারের জন্য দরখাস্ত করেন, হাইকোর্টে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারির পক্ষে মত দেন। আর কনিষ্ঠ বিচারপতি সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ভিন্নমত দেন। আগামী অন্তত আরও কয়েকদিনের মধ্যে আদালতের রায় পাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বেশ আশাবাদী থাকতে পারেন। কিন্তু তৃতীয় বেঞ্চের অতীত রায়গুলো তাঁদের পক্ষে যাওয়ার নজির নেই।

খালেদা জিয়ার নাম ও প্রতীক ব্যালটে থাকবে কি না, তা বলা তাই যারপরনাই অনিশ্চিত।

ব্যালটের বহ্ন্যুৎসব

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের রায়ের আদেশের ভিত্তিতে ব্যালট পেপারে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে এবং এ জন্য লাখ লাখ ব্যালট পেপার পোড়ানো হয়েছে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনটি এ ক্ষেত্রে একটি বিরাট দৃষ্টান্ত। আজ সন্ধ্যায় এই বিষয়ে আমরা কথা বলি নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলির সঙ্গে। তিনি তথ্য দেন, ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৮ থেকে ২২টি আসনে ব্যালট পেপার পুনরায় ছাপাতে হয়েছিল। এ জন্য ৩০ থেকে ৩৩ লাখ ব্যালট পেপার পোড়ানো হয়। ২০০১ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আদালতের বিভক্ত আদেশ কখন প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে? সাধারণত জনগুরুত্বসম্পন্ন মামলায় উচ্চ আদালত ত্বরিত পদক্ষেপ নেন। তবে নির্বাচনী যোগ্যতা বিষয়ে রিটের শুনানি শেষে রুল পর্যায়ে কোনো বিভক্ত আদেশ সম্ভবত এই প্রথম। এমন নজির আগে ছিল কি না, তা আমরা স্মরণ করতে পারি না। অবশ্য এর আগে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল-সংক্রান্ত একটি রিট মামলায় বিভক্ত আদেশ দান এবং তৃতীয় বেঞ্চের রায় পেতে ২৪ দিনের ব্যবধান আমরা লক্ষ করেছিলাম।

সপ্তাহখানেক পরে শুরু হবে ব্যালট ছাপানোর কাজ। ঢাকায় চারটি সরকারি ছাপাখানায় মুদ্রণ চলবে। তবে ভোটের তারিখের কত দিন আগে ব্যালট মুদ্রণ শেষ করতে হবে, সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই।

আগামীকাল নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে তাঁরা ব্যালট মুদ্রণ অনুমোদন দেওয়া শুরু করবেন। ইসি নিশ্চয় আদালতের কোনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। কিন্তু ব্যালট ছাপানোই শেষ কথা নয়।


আইন কী বলে?
বিভক্ত রুল জারি করার বিষয়টি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ১৯৭৩ সালের রুলসের (২০১২ সালে সংশোধিত) চ্যাপ্টার ১১ক-এর আওতায় রুল ১৮ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটি বলেছে, ‘যখন কোনো একটি দ্বৈত বেঞ্চ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশ্নে সমানভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন, তখন বিভক্ত আদেশদানকারী বিচারকগণ তা প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠাবেন। প্রধান বিচারপতি তখন একজন বা একাধিক বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ উভয় পক্ষের শুনানি অন্তে তাদের মতামত চূড়ান্ত করবেন। বিভক্ত আদেশদানকারী বিচারকরাসহ পরে যারা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের সবার মতামত বিবেচনায় নেওয়া হবে। এবং বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে স্থির হবে।’

পূর্ব নজির
২০১৪ সালের ২৪ মে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় মামলার কার্যক্রম স্থগিত ও বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে করা রিট আবেদনের ওপর বিভক্ত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব মামলার বিচারিক কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিতের পাশাপাশি রুল জারি করেন। বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ রিট আবেদনটি খারিজ করেন। দুই দিনের শুনানি শেষে ১৯ জুন ২০১৪ বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের একক বেঞ্চ ওই বিষয়ে খারিজের পক্ষে আদেশ দেন।

১৫ এপ্রিল ২০১৫ গাড়ি পোড়ানোর দুই মামলায় মির্জা আব্বাসের আগাম জামিন প্রশ্নে হাইকোর্টের বিভক্ত আদেশের পরে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ২৬ এপ্রিল তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করেন। ১৫ এপ্রিল বিভক্ত আদেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকো‌র্টের দ্বৈত বেঞ্চ। বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল খারিজের পক্ষে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের দেওয়া সিদ্ধান্তের অনুকূলে ২৫ মে ২০১৫ আদেশ দেন।

গত জানুয়ারি ও গত অক্টোবরে আরও দুটি বিভক্ত আদেশ দেন একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে করা রিটে বিভক্ত আদেশ হাইকোর্ট গত জানুয়ারিতে দেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ৭০ অনুচ্ছেদ প্রশ্নে রুল দেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি খারিজ করেন।

রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ আজ আমাকে বলেন, বিভক্ত আদেশের প্রায় এক মাস পর উভয় বিচারকের আদেশ সংবলিত নথি প্রধান বিচারপতির কাছে যায়। তিনি বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করেন। সেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে খারিজের সপক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। তিনি তৃতীয় বেঞ্চের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল তৃতীয় বেঞ্চের শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন।

২০১৫ সালে ইউনূস আলী আকন্দ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্যপদ চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী মায়ার প্রতিকূলে রুল দিলেও অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল আবেদনটি ১৭ আগস্ট ২০১৫ খারিজ করেছেন। ১১ নভেম্বর ২০১৫ রিট আবেদনটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।
আট দিনের মাথায় কনিষ্ঠ বিচারকের রুল খারিজের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের একক বেঞ্চ।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, এমন অভিযোগ করে বিএনপিপন্থী তিন আইনজীবীর রিট আবেদনের ওপর গত ৯ অক্টোবরে বিভক্ত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী রিটটি আমলে নিয়ে গায়েবি মামলা করার অভিযোগটি তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। একই বেঞ্চের অপর বিচারপতি আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি সংবিধানবহির্ভূত আখ্যায়িত করে তা সরাসরি খারিজ করেছেন।
বিভক্ত আদেশের ৪৬ দিনের ব্যবধানে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের তৃতীয় বেঞ্চ হাইকোর্টে রিট আবেদনটি খারিজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করেন।
‘বিভক্ত আদেশের কপি অবিলম্বে আশা করি’, সন্ধ্যায় নির্বাচনী এলাকা থেকে মুঠোফোনে বললেন খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী কায়সার কামাল। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি জয়নুল আবেদীন রাত সোয়া নয়টায় মুঠো ফোনে আদেশের কপি পাওয়া নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে তিনি বলেন,‘ জ্যেষ্ঠ বিচারপতি রুল জারি করেছেন। এবং তিনি (বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ) বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা যে আদেশ দিয়েছেন তা যথাযথ হয়নি।’
আশির দশকে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সাল থেকে যতবারই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, ততবারই জয়ী হয়েছেন। পাঁচটিতেও জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এবারে ‘এতিমের অর্থ আত্মসাৎ’ মামলায় দণ্ডিত হিসেবে তিনটিতে ভোটে দাঁড়ানোর ভাগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।