নির্বাচনী ইশতেহার

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণনা শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। তাঁরা নিজ নিজ দল বা জোটের পক্ষে ভোটারদের সমর্থন আকর্ষণের চেষ্টা করছেন, কিন্তু নির্বাচিত হলে তাঁরা দলগতভাবে দেশ ও জাতির জন্য কী করবেন, সে সম্পর্কে তেমন কিছু এখনো জানা যায়নি। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে অনেক প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে, লিখিত ও মুদ্রিত আকারে সেগুলোর উপস্থাপন ঘটে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের পথে দলগুলোর প্রস্তুতি অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সময়ও আর বেশি নেই; কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেনি।

ভোটাররা কোন দলকে কী প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ভোট দেবেন—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা একটা স্বাভাবিক ও প্রচলিত কৌতূহলের বিষয়। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সেসব আহ্বানে সাড়া দেয়, কখনো কখনো আহ্বান ছাড়াই তারা ভোটারদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণের উদ্দেশ্যে নানা প্রতিশ্রুতিসংবলিত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ ও প্রচার করে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহ কম। এর কারণ সম্ভবত এই যে দলগুলো নির্বাচনের আগে ইশতেহারের মাধ্যমে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চায়, নির্বাচিত হওয়ার পর সেগুলো পূরণ করে না। তাদের এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছে এবং জনসাধারণ সম্ভবত এই তিক্ত উপলব্ধিতে পৌঁছে গেছে যে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের আগে যত প্রতিশ্রুতিই শোনাক না কেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যাবে।

এটা একটা হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি, এভাবে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়মিতভাবে ভঙ্গ করা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তাহলে সেই গণতন্ত্রে জনসাধারণ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক থাকতে পারে না।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করার এই নেতিবাচক চর্চা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের গুরুত্ব আছে। কারণ, প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের সঙ্গে তাদের লিখিত ও মুদ্রিত চুক্তির মতো একটা বিষয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে জনসাধারণ তাদের নির্বাচিত সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার দাবি তুলতে পারে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জবাবদিহি চাইতে পারে এবং মেয়াদ শেষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারে।

নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো নির্বাচনের পরে পূরণ করা হবে কি না, সেই প্রশ্ন ছাড়াই বলা যেতে পারে, ইশতেহার প্রকাশিত হলে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ফোরামে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে; ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হতে পারে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো সমাজের বিভিন্ন অংশের দাবিদাওয়ার প্রতি সাড়া দিয়ে সেগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যেমন, সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আহ্বান জানিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো যেন তাদের ইশতেহারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি যুক্ত করে।

আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। একই সঙ্গে এটা প্রত্যাশিত যে, এসব প্রতিশ্রুতি যেন নিছক কথার কথা না হয়। সরকারে গেলে কী করবে আর বিরোধী দলে থাকলে কী করবে, সেই প্রতিশ্রুতিও থাকা প্রয়োজন।