মোদি মিথে কীভাবে চিড় ধরাল কংগ্রেস?

কংগ্রেসকে বিশেষভাবে সহায়তা করছেন দলিত নেত্রী মায়াবতী ও তাঁর দল বহুজন সমাজবাদী পার্টি
কংগ্রেসকে বিশেষভাবে সহায়তা করছেন দলিত নেত্রী মায়াবতী ও তাঁর দল বহুজন সমাজবাদী পার্টি

ভারতে রাজ্যসংখ্যা ২৯। তার পাঁচটিতে বিধানসভার ভোট হলো গত সপ্তাহে। ৫৪৫ আসনের লোকসভার ৮৩টি আসন রয়েছে এই পাঁচ রাজ্যে। শতাংশের হিসাবে যা ১৫ ভাগ। এই অর্থে পাঁচ রাজ্যের এই ভোটকে বলা যায় ‘মিনি জাতীয় নির্বাচন’।

আগামী এপ্রিল-মে মাসে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন হবে। উত্তেজনার ব্যাপকতায় যাকে ইতিমধ্যে বলা হচ্ছে ‘মাদার অব অল ইলেকশন ব্যাটল’। তার আগে পাঁচ প্রদেশের এই ভোটযুদ্ধ ছিল স্বাভাবিকভাবেই বড় আকারের এক রাজনৈতিক শক্তিপরীক্ষা। জাতীয় নির্বাচনের খুদে মহড়াও বলা যায় একে।

এই মহড়ায় বিজেপি খারাপ করেছে। বহু কারণে বিজেপির জন্য এই ফল উদ্বেগের। প্রধান কারণ, আলোচ্য পাঁচ রাজ্যের অন্তত তিনটি (মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়) বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এসব অঞ্চলে লোকসভার ৬৫টি আসন রয়েছে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একচেটিয়াভাবে ৬৫-এর মধ্যে ৬২টি আসন পেয়েছিল। বিজেপি তখন সারা দেশে ২৮২টি আসন পায়। এই অর্থে বলা যায়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড় তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের এক–পঞ্চমাংশ। সুতরাং একই অঞ্চলে তাদের এখনকার খারাপ ফলের অর্থ ২০১৯ সালের লোকসভায় আসন কমে যাওয়ার শঙ্কা। ইতিমধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে মোদি-অমিত শাহ জুটি কেন হারছেন? তাঁরা কি কংগ্রেস ও রাহুলের কাছে হারছেন? নাকি ভারতের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে কোনো ভিন্ন ধাঁচের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে?

আসনে হারলেও ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে বিজেপি
বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম সর্বশেষ ভারতীয় নির্বাচনের যে চিত্র তুলে ধরছে, তাতে মনে হতে পারে, বিজেপি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বিষয়টা সে রকম নয়। পাঁচ রাজ্যের প্রধান দুটিতে (মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে) বিজেপি আসনের হিসাবে হারলেও ভোটের হিসাবে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস পেয়েছে ১১৪টি আসন, বিজেপি পেয়েছে ১০৯টি। উভয় দল প্রদত্ত ভোটের ৪১ শতাংশ করে পেয়েছে। একে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই বলতে হবে।

রাজস্থানেও তা–ই। উভয় দলের ভোটের হিস্যা ৩৯ শতাংশ করে। যদিও কংগ্রেস পেয়েছে বিজেপির চেয়ে ২৬টি বেশি আসন। তেলেঙ্গানাতেও বিজেপির ভোটের হিস্যা গত নির্বাচনের মতোই রয়েছে ৭ শতাংশ। মিজোরামে তাদের ভোট শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়েছে ৮ শতাংশে।

ছত্তিশগড়ে কেবল বিজেপির পরাজয় সিদ্ধান্তসূচক। এখানে তারা ভোট পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের ৩৩ শতাংশ। কংগ্রেস পেয়েছে ভোটের ৪৩ শতাংশ এবং আসনের ক্ষেত্রেও পার্থক্যটা অনেক: কংগ্রেস ৬৮, বিজেপি ১৫।

অর্থাৎ যে পাঁচ রাজ্যে ভোট হয়েছে, তাতে বিজেপি কেবল একটিতে মোটাদাগে খারাপ করেছে। চারটিতে তারা এখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে আছে। তবে ভোটের হিস্যা তাদের কমেছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে মিজোরাম ব্যতীত বাকি চারটিতেই ভোটের হিস্যা বাড়িয়েছে। কিন্তু বিজেপির হারানো ভোট সব কংগ্রেস পায়নি; যদিও আসনের হিসাবে তারাই বিজয়ী।

বিজেপিবিরোধী ভোট কে কতটা পাচ্ছে
সর্বশেষ নির্বাচনে বিজেপির হারানো আসন কংগ্রেস পেলেও হারানো ভোটগুলো কংগ্রেসের বাইরেও গেছে। আগেই বলা হয়েছে, মিজোরামে তাদের ভোট বেড়েছে এবং তেলেঙ্গানায় স্থিতিশীল রয়েছে। অন্য তিন রাজ্যে তাদের ভোট কমেছে: ছত্তিশগড়ে ৮ শতাংশ, রাজস্থানে ৬ শতাংশ এবং মধ্যপ্রদেশে ৪ শতাংশ। লক্ষ করার মতো ব্যাপার, ওই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে যথাক্রমে ৩, ৬ ও ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপির হারানো ভোট কংগ্রেস সব পাচ্ছে না। যাচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলোর দিকেও।

বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম পাঁচ রাজ্যের ভোটে বিজেপির ‘পরাজয়’ নিয়ে যতটা উচ্ছ্বসিত, ততটাই নীরব মিজোরাম ও তেলেঙ্গানায় আঞ্চলিক দুটো দলের বিজয়ে। কংগ্রেস ও বিজেপির এই হাইভোল্টেজ ম্যাচে ভারতের প্রায় সব মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবিতা যখন তাদের পাশে, তখন পাঁচ রাজ্যের দুটিতেই ভোটে জিতে যাচ্ছে দুটি আঞ্চলিক দল। এটা বিপুল বিস্ময় বৈকি। লক্ষ করার মতো ব্যাপার, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি (টিআরএস) ভোটে জিতেছে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ৭০ আসন বেশি পেয়ে। মিজোরামেও মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে চার গুণ বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। সেখানে এমনকি দ্বিতীয় স্থানও পেয়েছে আরেকটি আঞ্চলিক দল। ভোটেরও হিস্যাও এমএনএফ গত নির্বাচনের ২৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে নিয়েছে ৩৮ শতাংশে। তার মানে তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে জাতীয় দুই দল বিজেপি ও কংগ্রেস পাত্তা পায়নি। ছত্তিশগড়ে অজিত যোগীর নেতৃত্বে গঠিত ‘জনতা কংগ্রেস’ (জেসিসি) নামে গঠিত নবীন একটা আঞ্চলিক দল বিজেপি ও কংগ্রেসকে মোকাবিলা করেই এই প্রথম পাঁচটি আসন পেয়ে গেল।

আবার প্রায় সব প্রদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট বেড়েছে। রাজস্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মধ্যপ্রদেশে ৫ শতাংশ। সর্বত্র বিজেপি-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করেই স্বতন্ত্ররা ভোট বাড়িয়েছে। এসব দৃশ্য ২০১৯ সালে কেন্দ্রে একটা জোট সরকারের ইঙ্গিত দেয়।

ভারতের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে কৃষকদের বিশাল লংমার্চগুলো রাজনীতির এজেন্ডায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে
ভারতের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে কৃষকদের বিশাল লংমার্চগুলো রাজনীতির এজেন্ডায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে

মায়াবতী কংগ্রেসকে সাহায্য করছেন
প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার গঠন করছে। কিন্তু সামান্যই উল্লেখ করছে যে ভোটে এবং সরকার গঠনে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে কংগ্রেসকে বিশেষভাবে সহায়তা করছেন দলিত নেত্রী মায়াবতী ও তাঁর দল বহুজন সমাজবাদী পার্টি। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ১১৪ আসন পেলেও সরকার গঠনের চেয়ে তা দুই আসন কম ছিল। মায়াবতীর দল সেই ব্যবধান পূরণ করে দিয়েছে। রাজস্থানেও বহুজন সমাজবাদী পার্টি ছয়টি আসন পেয়েছে এবং সরকার গঠনে কংগ্রেসকে সহায়তা করছে।

যেকোনো মূল্যে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার নীতি নিয়েছেন মায়াবতী। ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে তিনি বিজেপিকে মোকাবিলায় ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছ থেকে সহায়তা চাইবেন বলেই মনে হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতজুড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে দলিত ও মুসলমানরা যে একসুরে একজোট হয়ে লড়তে চাইছে, মায়াবতীর ভূমিকা তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মায়াবতী ও অন্য দলিত নেতারা এই অবস্থান বজায় রাখলে বিজেপির জন্য দলিতপ্রধান রাজ্যগুলোয় সংকটের সৃষ্টি হবে।

উত্তর প্রদেশ, বিহার, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতে দলিতদের বিরাট অঙ্কে ভোটের হিস্যা রয়েছে। দলিতরা বরাবর কংগ্রেস–সমর্থক হলেও মায়াবতীর দল এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। বিজেপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলিত ভোটব্যাংকে ভাগ বসিয়েছিল, যা মায়াবতী ও কংগ্রেস উভয়ের ক্ষতি করে। মায়াবতী কংগ্রেসকে পাশে নিয়ে এবার বিজেপিকে দলিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। উত্তর প্রদেশ সে কারণেই বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ এ মুহূর্তে। কেবল উত্তর প্রদেশেই রয়েছে লোকসভার ৮০টি আসন এবং এখানে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, সচরাচর তারাই কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের চিত্র বলে দিচ্ছে, ভারতের আগামী নির্বাচনে বিজেপি ও বিজেপিবিরোধী শিবিরের ভাগ্য নির্ধারিত হবে মূলত উত্তর প্রদেশে।

গরু ও মন্দিরের রাজনীতিকে মোকাবিলায় কৃষক রাজনীতি
এ সপ্তাহের নির্বাচনী ফল বিজেপি শিবিরের জন্য প্রায় অচেনা এক দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে। গত চার বছর এই দলের নেতৃত্বকে ঘিরে প্রায় অপরাজেয় এক ইমেজ তৈরি হয়। মোদি-অমিত শাহ জুটি গরু নিয়ে দলিত ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেরূপ অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছেন, তা ছিল অবিশ্বাস্য বর্বরতা। এই দুজন তৃতীয় যাঁকে নির্বাচনের প্রচারদূত বিশেষভাবে ব্যবহার করেছিলেন, যেই যোগী আদিত্যনাথ ছিলেন উগ্রতায় আরও এক কাঠি বাড়া। বিজেপির মধ্যকার মধ্যপন্থীদেরও এই ত্রয়ী কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। এই তিনজন ভাবছিলেন, গরু, মন্দির এবং বিভিন্ন শহরের নাম পরিবর্তনের রাজনীতি দিয়েই হিন্দুবলয়ের ভোটারদের মন জয় করা যাবে। আদিত্যনাথ সর্বশেষ নির্বাচনকালে মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-ছত্তিশগড়জুড়ে প্রায় ১০০ সমাবেশ করেছিলেন। মুখরোচক কিছু ধর্মবাদী স্লোগান ও উত্তেজক মুসলমানবিরোধিতাই থাকত তাঁর বক্তব্যের মূল অংশ।

নির্বাচনী প্রচারকালে বিজেপি সরকার ভারতজুড়ে অনেক শহরের নাম (ফয়েজাবাদ, এলাহাবাদ ইত্যাদি) পরিবর্তন করেছিল মুসলমানবিরোধী ঘৃণাকে উসকে দিতে। এখন দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী এলাকাগুলোয় মূলত কৃষিপণ্যের দাম পড়ে যাওয়ায় ভোটের অঙ্ক প্রভাবিত হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ম নয়, মোদির ব্যক্তিত্বের জাদুও নয়, কৃষিপ্রশ্নই ভোটের হিসাবে মধ্যভারতে গোপনে মূল প্রসঙ্গ হয়ে গেছে।

গত কয়েক মাসে ভারতের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে কৃষকদের বিশাল লংমার্চগুলো রাজনীতির এজেন্ডায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। মূলত, বামপন্থী ও পরিবর্তনবাদী কৃষক-শ্রমিক সংগঠনগুলো এসব লংমার্চের আয়োজক। ভোটের ময়দানে তারা সরাসরি খুব বেশি ফায়দা না পেলেও এমন একটি এজেন্ডা সামনে আনতে পেরেছে, যা সরাসরি আঘাত করছে মোদি মিথে। মোদি অপরাজেয়—আপাতত এই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন মধ্য ও উত্তর ভারতের কৃষিজীবীরা। পাশাপাশি শহরে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি নিয়েও তরুণেরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।

মোদির সামনে বিকল্প কী
পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের পরই ভারতজুড়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে, মোদি-অমিত শাহ-আদিত্যনাথ ত্রয়ী এখন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কী কৌশল নেবেন। করপোরেট স্বার্থের প্রায় অন্ধ পতাকাবাহী হিসেবে মোদির পক্ষে এ ক্ষেত্রে একটাই বিকল্প খোলা রয়েছে, তা হলো অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণের রাজনীতিকে জোরেশোরে সামনে আনা এবং ভারতীয় সমাজকে আরও বেশি সাম্প্রদায়িক ধারায় বিভক্ত করা। অর্থাৎ মন্দিরের রাজনীতি বিজেপি-আরএসএস পরিবারের জন্য আসন্ন দিনগুলোয় একমাত্র ভরসা হিসেবে থাকছে। কিন্তু তা কতটা কাজে দেবে, সে প্রশ্নের এখন আর নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই। পাঁচ রাজ্যের ভোটের পর ভারতীয় পুঁজিপতিরা নিশ্চয়ই এখন আর পুরো বাজি কেবল বিজেপির ওপর ধরবেন না।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।