ভোট পাহারা দিন

জাতীয় স্মৃতিসৌধ
জাতীয় স্মৃতিসৌধ

আজ আমরা বাংলাদেশের ৪৮তম মহান বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করছি। আমাদের এই বিজয় অর্জিত হয়েছে এক সাগর রক্ত ও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে। মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণকে এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে জীবনকে বাজি রেখে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়েছে। একটি প্রখ্যাত সংগীতে বলা হয়েছে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ এবং প্রকৃতপক্ষেই এটা সত্য যে এমন একটি দেশ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যে এ দেশের জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান রচনা করা হয়েছে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে। সেই পবিত্র সংবিধানের প্রথমেই রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর। তা ছাড়া, এরপরই রয়েছে জাতীয় দুই নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষর। ৪৬ বছর আগে আজকের এই দিনে আমাদের সংবিধান কার্যকর হয়।

সংবিধানপ্রণেতাদের স্বাক্ষরিত সংবিধান ৪৬ বছর ধরে শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কার্যকর রয়েছে। সেই স্বাক্ষরিত সংবিধানটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বিজয়ের মাত্র চার বছরের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর একনিষ্ঠ চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ’৭২-এর সংবিধানকে ৪৬ বছর যাবৎ রক্ষা করাও ছিল জাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

বিগত সময়ে ক্ষমতার দাপটে সংবিধানকে বারবার ‘অকার্যকর’ করার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এই পবিত্র সংবিধানটিকে একাধিকবার ‘স্থগিত’ করা হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানটি অদ্যাবধি বেঁচে আছে। ইতিমধ্যে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে অগণতান্ত্রিক পন্থায় সংবিধানে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সংশোধনী আনা হয়, যা পরবর্তী সময়ে অসাংবিধানিক বলে আদালত ঘোষণা করেন।

আরও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল জনসংখ্যা, যা একাত্তরের তুলনায় দ্বিগুণ। আমাদের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ থেকে ১৮ কোটি। তদুপরি আমরা উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সুশাসনের অভাব এবং নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতেও জনগণের সন্দেহাতীত দেশপ্রেম এবং দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই ইতিবাচক সফলতার কারণ।

এত সমস্যার পরও আমরা বিজয়ের পর ৪৭ বছর অতিবাহিত করেছি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। আমরা এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি ২০২১ সালে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে পালনের জন্য। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে এখন আমাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিতভাবে আরও উত্তর উত্তর সাফল্যের দিকে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের আগামী দুই সপ্তাহ অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে আমরা আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণের বিজয় নিশ্চিত করতে পারি।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭০ সালে ঢাকায় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করার। তখন সিনিয়র বাঙালি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানতে পারি যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করার ব্যবস্থা করেছে। আমি তা বঙ্গবন্ধুকে অবগত করলে তিনি আমাকে বলেন, ‘টাকা দিয়ে নয়, বরং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।’

আমি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে বাড়ি বাড়ি, প্রতিটি অলিগলিতে গিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাই। আমাদের দায়িত্ব ছিল জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, প্রত্যেক নাগরিক যেন তাঁর ভোটাধিকার সুবিবেচনাপ্রসূত প্রয়োগ করেন। কোনোভাবেই যেন তাদের ভোট না দেন, যারা তাঁদের দুই দশক ধরে শোষণ করেছে এবং তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পাচার করেছে। আমাদের মেয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা নারী ভোটারদেরও একইভাবে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।

আজকেও সেই অক্লান্ত পরিশ্রমী স্বেচ্ছাসেবকদের ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ করে আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে। আমরা এই নির্বাচনেও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে আরও দু-এক মাস সময় চেয়েছিলাম, যা উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার কোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রি হতে পারে না।

কাজেই এবারের নির্বাচনে নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হবে দুটি। প্রথমত, দেশের মালিক হিসেবে তিনি যেন তাঁর ভোটাধিকার সুবিবেচনাপ্রসূতভাবে প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যেন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সজাগ দৃষ্টি রাখেন।

উল্লেখ্য, প্রতিটি নাগরিককে অর্থবহ নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যে নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে; যেখানে পেশিশক্তি, অর্থের দৌরাত্ম্য ও ভোট কারচুপি করার সুযোগ না থাকে। এটাই হোক আমাদের ৪৮তম বিজয় উৎসবের মর্মবাণী।

ড. কামাল হোসেন : গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা