দুটি হত্যাকাণ্ড ও হুকুমের আসামি

মেজর জেনারেল মনজুর, সাংবাদিক জামাল খাসোগি।
মেজর জেনারেল মনজুর, সাংবাদিক জামাল খাসোগি।

প্রায় দুই মাস হতে চলল, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শেষ হয়নি। এর প্রধান কারণ দুটি। এক. এ রকম নির্মম হত্যার বিবরণ এর আগে এত খোলাখুলিভাবে খুব কম আলোচিত হয়েছে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। দুই. এই হত্যাকাণ্ডে আনুষ্ঠানিক না হলেও কার্যত এক রাষ্ট্রপ্রধানের সম্পৃক্ততা। সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে যদি কোনো গোপন বা প্রত্যক্ষ সরকারি সংস্থা গুম করে হত্যা করত, অথবা খাসোগির জায়গায় অন্য কোনো সাংবাদিক হতেন, তাহলে বোধ করি এত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো না; এ নিয়ে পৃথিবীর বড় দেশগুলো এত মাথা ঘামাত না।

মুশকিল হলো, সৌদি নাগরিক জামাল খাসোগি সাধারণ সাংবাদিক নন, তাঁর খ্যাতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। তদুপরি তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের
স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। স্বদেশ সৌদি আরবে থাকাকালে তাঁর নাম তেমন কেউ জানত না। কারণ, তিনি তাঁর পেশার প্রথম দিকে সৌদি সরকার বা
সৌদি রাজপরিবারের কোনো বিশেষ সমালোচনা করেননি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি এক বই বিক্রির দোকানের ম্যানেজার ছিলেন, পরে সাংবাদিকতা শুরু করেন তাঁর দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি দিয়ে। সেসব লেখায় কখনো তিনি সৌদি সরকারের নীতি বা রাজপরিবারের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেননি। ২০০৩ সালে তিনি আল ওয়াতান পত্রিকার সম্পাদক নিয়োজিত হন। সে বছর তিনি ওই পত্রিকায় ওহাবি মতাদর্শের এক প্রধান অনুসারীর সমালোচনাসূচক একটি লেখা প্রকাশ করেন। এর আগে কিছু লেখায় ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদি আরবের চলমান যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন বিদেশি পত্রপত্রিকায়। আল ওয়াতান পত্রিকা যা সরকারি নীতি মেনে চলে, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে সম্পাদকের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়।

২০০৩ সালেই খাসোগি যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান এবং লন্ডন থেকে বিভিন্ন পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করে খ্যাতি লাভ করেন। কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত সৌদি বাদশাহর এক পুত্র তুর্কি আল ফয়সাল খাসোগিকে তাঁর সংবাদমাধ্যম সহকারী নিয়োগ করেন। এর ফলে খাসোগি ২০০৭ সালে আবার আল ওয়াতান–এর প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। কিন্তু তিন বছরের মাথায় আবার তিনি সৌদি সরকারের রোষানলে পড়েন। কারণ, তাঁর অনেক লেখা সরকারকে বিব্রত ও অসন্তুষ্ট করে। তিনি আবার দেশ ত্যাগ করেন।

২০১৭ সালে তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। সৌদি সরকার ও রাজপরিবারের সমালোচনার জন্য তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

খাসোগি সৌদি সরকার ও রাজপরিবারের বিরাগভাজন অনেক আগে থেকেই ছিলেন, কিন্তু তাঁর আমেরিকা–বাস ও লেখালেখি রাজপরিবারকে খুবই উত্ত্যক্ত করে, বিশেষ করে পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে মনোনীত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে। মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) খাসোগিকে নিরস্ত করতে অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু বিশেষ কাজ হয়নি। এক তুর্কি সাংবাদিকের সঙ্গে বিয়ের জন্য তাঁর প্রয়োজন হয় প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের প্রমাণের নথি, সেটা ছিল তাঁর দেশে। তিনি সেই কাগজের জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ জানালে তাঁকে বলা হয়, সেটা তিনি ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গেলে পেতে পারেন। সেই আশায় তিনি গত অক্টোবর মাসে সেই কনস্যুলেটে যান। এটাই তাঁর কাল হলো।

ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খাসোগির নির্মম ও বীভৎস হত্যার বিবরণ ইতিমধ্যে বহুল প্রচারিত। এখানে পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। আমি বলতে চাই, এ হত্যার সঙ্গে সৌদি সরকারের ওপরমহলের সম্পৃক্ততা বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এ হত্যার সঙ্গে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রচারিত হচ্ছে। সৌদি সরকার প্রথমে বলেছিল, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না। পরে তুর্কি সরকার প্রমাণ হাজির করলে সৌদি সরকার তাদের ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে খাসোগির মৃত্যুর কথা স্বীকার করে, তবে এটাকে তারা একটি দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টায় ফল হয়নি। কারণ, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাদের নিজস্ব গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে শুধু সৌদি সরকারকে এ হত্যার জন্য দায়ী করেনি, সোজা আঙুল দেখিয়েছে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে। প্রতিবেদনে এ–ও বেরিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত খালিদ বিন সালমান (যিনি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ছোট ভাই) খাসোগিকে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের নথি সংগ্রহ করতে কীভাবে ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে যাওয়ার পরামর্শ দেন। খালিদ খাসোগিকে ওই পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই যুবরাজ মোহাম্মদের আদেশে। তার পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি।

খাসোগি হত্যায় সৌদি সরকারের, বিশেষত যুবরাজ মোহাম্মদের সম্পৃক্ততা প্রবলভাবে অস্বীকার করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কোনোভাবেই মানতে চাইছিলেন না যে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ হত্যা সম্পর্কে কিছু জানতেন, সম্পৃক্ততা তো দূরের কথা। সিআইএর প্রতিবেদনের পরও তিনি একই সুরে গাইতে থাকেন যে যুবরাজ এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। পরে সাংবাদিকদের চাপে তিনি বলে বসেন, হয়তো যুবরাজ কিছু জানতেন, হয়তো কিছু জানতেন না। কিন্তু শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে আমি সৌদিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি ডলারের অস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ করতে পারি না। এর অর্থ সৌদি সরকার বা সৌদি রাজপরিবার তাদের নিজস্ব লোকদের সঙ্গে কী ব্যবহার করল, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে রাজি নই।

সৌভাগ্য এই যে ট্রাম্প মাথা না ঘামালেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বসে নেই। সিনেটের এক বিশেষ দল ইতিমধ্যে সিআইএর প্রধানের কাছ থেকে তাদের প্রতিবেদন নিয়ে খাসোগি হত্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছে। তারা সিনেটে এ নিয়ে সৌদি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, যেন এ হত্যাকাণ্ড ও হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচার হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের চাপে যুবরাজ মোহাম্মদ কতটা বিপদে পড়বেন, তা বলা দুষ্কর। কিন্তু খাসোগি হত্যাকাণ্ড সহজে আড়ালে চলে যাবে না, যেমনটি গেছে আজ থেকে ৩৭ বছর আগে বাংলাদেশে সংঘটিত একটি হত্যার ঘটনা। আমি নিজে ছিলাম ওই ঘটনার এক পরোক্ষ সাক্ষী।

১৯৮১ সালের ২ জুন মেজর জেনারেল মনজুরকে হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, লোকচক্ষুর অন্তরালে রাতের অন্ধকারে। জেনারেল মনজুর ছিলেন সেই সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকর্তা। আমি তখন বৃহত্তর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। এর তিন দিন আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানরত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেন কিছু সেনা কর্মকর্তা। যেহেতু জেনারেল মনজুর তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অধিকর্তা, এটা অনুমিত হয় যে এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে তাঁর নির্দেশে। এর পরবর্তী কার্যকলাপ থেকে মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো এ ঘটনার নায়ক। কিন্তু এ ঘটনা বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মনজুর পালিয়ে গেলেন ঘটনার তিন দিন পর, পথে ধরা দিলেন পুলিশের হাতে। তিনি চাইছিলেন তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হোক এবং সিভিল আইনে তাঁর বিচার হোক। কিন্তু তা হলো না, তাঁকে পুলিশ হেফাজত থেকে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের আদেশে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতে সেনা দপ্তরের ওপরওয়ালার নির্দেশে মনজুরকে হত্যা করা হয়।

মনজুর হত্যার অনেক বছর পর নতুন করে এর তদন্ত এবং বিচার শুরু হয়। আজ ৩৭ বছর পরেও বিচার শেষ হয়নি। মনজুর হত্যার হুকুমের আসামি কে, তা আমরা আন্দাজ করেই যাচ্ছি, কিন্তু তাঁর বিচার কোনো দিন হবে কি না, জানি না। খাসোগি হত্যাকাণ্ডে হুকুমের আসামিকে চিহ্নিত করা গেছে, তবে তাঁর বিচার কী হবে কিংবা বদলে আর কেউ বলির কাঠে উঠবে কি না, তা বলা দুষ্কর। দুটি হত্যার মধ্যে তফাত এই যে, খাসোগি হত্যা একটি আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে, এর সুষ্ঠু বিচার সৌদি সরকার এড়াতে পারবে না। কিন্তু মনজুর হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারছে। কারণ, এ নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক মহলে মাথাব্যথা নেই। আর যে ব্যক্তিকে হুকুমের আসামি মনে করা হয়, তিনি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক এবং Assassination of Ziaur Rahman and aftermath বইয়ের রচয়িতা