প্রকৃত মজুরির পতন

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি, নিম্ন মূল্যস্ফীতি’র বলয়ে প্রবেশ করেছে। ছয় বছর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের সামান্য ওপরে, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা উঠে এসেছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে। এই সময়কালে প্রতিবছর গড়ে অর্থনীতির আয়তন বেড়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। আবার একই সময়কালে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে। এসব অর্জন নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট থাকা যায় যতক্ষণ না প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এর বণ্টন কিংবা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরির অবস্থা মিলিয়ে দেখা যায়।

প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনীতির আয়তন বাড়ার মানে হলো দেশের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের আয়-উপার্জন আগের তুলনায় বাড়া, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হওয়া। মজুরি পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্তে এ বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মজুরি প্রবৃদ্ধির তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হলে তা প্রবৃদ্ধির বণ্টন বা ভাগাভাগির কিছুটা হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ‘বৈশ্বিক মজুরি প্রতিবেদন ২০১৮-১৯’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ২০১৬ সালে যেখানে ছিল ২ দশমিক ৪০ শতাংশ, সেখানে গত বছর বা ২০১৭ সালে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮০ শতাংশে। তার মানে, প্রকৃত মজুরি বাড়লেও এই বৃদ্ধির হার আগের চেয়ে কমে গেছে এবং ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। আইএলওর প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর দেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ হারে, যা ২০১৬ সালে ছিল ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। আবার গত এক দশকে (২০০৮-১৭) গড়ে প্রতিবছর প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ হারে, যা ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম। আবার গত দেড় যুগে (২০০০-২০১৭) বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৩ শতাংশ হারে, যা এই তিন দেশ ছাড়া পাকিস্তান ও ইরানের চেয়েও কম।

এসব উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে মজুরি তথা শ্রমজীবী মানুষের আয়-উপার্জন-উন্নতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট সুবিধা করে উঠতে পারেনি; বিশেষ করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি-নিম্ন মূল্যস্ফীতির কালপর্বে প্রকৃত মজুরি সামান্য হারে বাড়ায় প্রবৃদ্ধির গুণগত দিক নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়।

এখানে বলা প্রয়োজন যে মজুরি দুই প্রকার। নামিক মজুরি ও প্রকৃত মজুরি। শ্রমিক নির্ধারিত সময়ে কাজের বিনিময়ে মজুরি বা পারিশ্রমিক হিসেবে যে নগদ অর্থ বা টাকা পেয়ে থাকেন, সেটাই তাঁর নামিক মজুরি। এই সময়কালে মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে নামিক মজুরি সমন্বয় করার পর যা পাওয়া যায়, তা হলো প্রকৃত মজুরি। অন্যভাবে বললে নামিক মজুরির ক্রয়ক্ষমতা হলো প্রকৃত মজুরি। আইএলওর উপাত্ত বিবেচনায় নিলে ২০১৩-১৭ সময়কালের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আবার একই সময়কালের (পাঁচ বছরের) বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার মোটামুটি নিচু পর্যায়ে থাকলেও তা নামিক মজুরি এতটাই খেয়ে ফেলেছে যে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের অর্ধেকে নেমে গেছে। বিষয়টা এমন নয় যে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। তবে যে হারে বেড়েছে, সে হার খেয়ে-পরে হাতে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকার মতো।

আবার পাঁচ বছরের (২০১৩-১৭) জিডিপির বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এই হারও প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির গড় হারের দ্বিগুণ। অর্থাৎ অর্থনীতির আয়তন ও সক্ষমতা যে গতিতে বাড়ছে, তার কাছাকাছি হারেও প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। যদি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নামিক মজুরি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলেও দেখা যায় যে মজুরি বৃদ্ধির হার পিছিয়ে আছে।

উল্লেখ্য, বিবিএস প্রতি মাসে নামিক মজুরি সূচক প্রকাশ করে থাকে। এতে দেশের ৪০টির বেশি খাতে আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের নামিক মজুরির একটি সমন্বিত চিত্র পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, পাঁচ বছরে দেশে নামিক মজুরি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ বা বছরে গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ হারে। এটিও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হারের নিচে রয়েছে। এমনকি এটি মূল্যস্ফীতির হারের নিচে। সেদিক থেকে হিসাব করলে দেশে প্রকৃত মজুরি না বেড়ে বরং কমে গেছে, এমনটিই প্রতীয়মান হয়।

আবার বিবিএস ২০০৫-০৬ অর্থবছর পর্যন্ত নামিক মজুরি সূচকের পাশাপাশি প্রকৃত মজুরি সূচক প্রকাশ করত, প্রকাশ করত শিল্পশ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় সূচক। এরপর থেকে নামিক মজুরি সূচক প্রকাশনা অব্যাহত থাকলেও বাকি দুটো এখনো বন্ধ রয়েছে। তাই এখন প্রকৃত মজুরি ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিসংখ্যানভিত্তিক বিস্তারিত চিত্র পাওয়া কঠিন। ফলে বিকল্প বিভিন্ন সূচক দিয়ে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা পেতে হচ্ছে।

আসলে প্রকৃত মজুরির এসব চিত্র কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে আসে। প্রথমত, শ্রমজীবী মানুষের দর–কষাকষির ক্ষমতা কমে গেছে। বিশ্বজুড়েই শ্রমিক সংঘের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা কমে গেছে, যা বাংলাদেশেও ঘটেছে। অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের পাশাপাশি শাসনক্ষমতা ও নীতি–নির্ধারণে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মালিকদের বেড়ে চলা প্রভাব এর অন্যতম কারণ।

দ্বিতীয়ত, এই প্রভাবের ফলে শ্রমবান্ধব আইন ও নীতিমালার ঘাটতি দেখা দিয়েছে; বরং এসব আইনকানুন ক্রমেই বৈষম্যমূলকভাবে মালিকবান্ধব হচ্ছে।

তৃতীয়ত, এসবের ফলে জিডিপিতে শ্রমজীবীদের প্রকৃত হিস্যা কমে যাচ্ছে; যা শুধু আয়বৈষম্য বেড়ে চলারই আভাস দেয় না, ব্যয়ের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের বৈষম্য দেখায়। আগামী দিনগুলোয় এসব বৈষম্য ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার নীতি ও পদেক্ষেপে জোর দেওয়ার বিষয়টি জরুরি।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক