আসুন, সুস্থ থাকি সুস্থ রাখি

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সেদিন একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করছিলেন। উপস্থিত ছিলাম আমিও, একজন আলোচক হিসেবে। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ছিলেন আমার পাশে। তিনি বললেন, প্রথম আলো যদি একটা কাজ করে, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষের বিরাট উপকার হয়। আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘কী করতে হবে বলুন স্যার।’ তিনি বললেন, ‘আপনারা প্রতিদিন শুধু প্রচার চালিয়ে যাবেন, “ধূমপানমুক্ত ও গাড়ির হর্নমুক্ত ঢাকা চাই”। এ দুটি উপদ্রব জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে।’

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘প্রচার করে যাব, অবশ্যই করব।’ আমি নিজেও ধূমপানের শিকার। ২০ বছর আগে আমার হার্ট বাইপাস সার্জারিতে যেতে হয়েছে। তখন হার্ট সার্জন আমাকে জেরা করা শুরু করেন। বললেন, ‘আপনার তো হার্টের সমস্যা হওয়ার কথা না। মা–বাবা কারও হার্ট অ্যাটাক হয়নি। অথচ আপনি এত কম বয়সে কেন এই বিপদে পড়লেন।’ এরপরই তিনি সেই প্রশ্নটি ছুড়ে দিলেন, ‘আপনি কি ধূমপান করেন?’ বললাম, ‘৩২ বছর ধরে করছি। মাত্র কয়েক দিন আগে ছেড়ে দিয়েছি।’ সার্জন বললেন, ‘এই তো, এটাই কারণ। যাক, এখন দেখেন ক্যানসার হয় কি না। ১৫ বছর যদি পার করতে পারেন, তাহলে আশঙ্কা অনেকটাই কেটে যাবে।’

ডা. মোজাহেরুল হক সামনের আসনে বসা নেপালের প্রতিনিধির দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওই দেখুন, ওই যে, নেপাল তো এটা করেছে। কাঠমান্ডু একেবারে ধূমপানমুক্ত এবং সেখানে কোনো গাড়ি হর্ন বাজায় না।’ আমার একটু লজ্জাই লাগল। নেপাল পারে, আমরা পারি না কেন? অথচ আমরা তো কত এগিয়ে যাচ্ছি। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ছে। তাহলে আমরা কেন ধোঁয়া টেনে এত মজা পাই? সরকার আইন করেছে, কিন্তু কেউ মানে না। রাস্তায় প্রকাশ্যে ধোঁয়া ফুঁকছে সবাই। আমরা অনেক সময় বলি, ও, সিগারেট ছেড়ে দেওয়া তো সবচেয়ে সহজ। বছরে অনায়াসে কয়েকবার ছাড়তে পারি। এর মানে, ছাড়ব আবার কয়েক দিন পরই ফোঁকা শুরু করব। না, এ রকম হলে তো চলবে না।

আসলে একটানা দু–তিন দিন ধূমপান ছেড়ে থাকতে পারলে আর ইচ্ছা হবে না। আমরা অনেকেই এটা বুঝি না। নিকোটিন শরীরে একটু উত্তেজনা আনে। সেটাই নেশা ধরায়। টেনশন বা মন খারাপ হলে সিগারেটে জোরসে ফুঁ লাগাই। আর সব ভুলে থাকি। কিন্তু আমরা জানি না যে মানুষের শরীরই এসব ব্যাপারে বড় ডাক্তার। দুশ্চিন্তা-মন খারাপ হলে শরীরই বিশেষ ধরনের হরমোনের নিঃসরণ ঘটায়। এটাই মন ভালো করে দেয়। কিন্তু সিগারেট খেলে শরীর দেখে, হরমোনের কাজটা নিকোটিন যখন করছে, তাহলে আর দরকার কী। এ জন্যই সিগারেট ছাড়া একটু কঠিন। কারণ, তখন হরমোনের নিঃসরণ বন্ধ, আবার সিগারেট খাওয়া বন্ধ। এ সময়টাই একটু অস্থির যায়। যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় উইথড্রয়াল সিনড্রোম। কিন্তু সেটা মাত্র দু-তিন দিন। এরপরই শরীর আবার হরমোন সরবরাহ শুরু করে। তারপরই সব ঠিক। আমি একেবারে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এটা বুঝেছি।

আর গাড়ির হর্নের কথা কী বলব। এটাও সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। শুধু গাড়ির হর্নে যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। শব্দদূষণ সাজানো কোনো কথা নয়। কানের বারোটা বাজিয়ে দেয়। মানুষের কান নষ্ট করার অধিকার কে গাড়িওয়ালাদের দিয়েছে? বিলাত-আমেরিকায় কেউ হর্ন বাজায় না। শুধু যদি কেউ নিয়ম না মেনে রাস্তায় গাড়ির সামনে চলে আসে, অথবা হঠাৎ বাঁক নেয়, তখনই হর্ন বাজায়। এর অর্থ, এই বোকা, তুমি কী করছ?

কিন্তু আমাদের দেশে এটা যেন ফ্যাশন। যখন-তখন হর্ন। শুধু পথচারীই না, গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আমাদেরও কানে তালা লাগে। অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ঠিকই বলেছেন। এই দুই উপদ্রব বন্ধ না করা পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় রোধ করা যাবে না।

সেমিনারে আরও কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন, আমরা যখন-তখন অ্যান্টিবায়োটিক খাই। নিয়ম মানি না। এমনকি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই দু–তিন দিন খেয়ে যেই না দেখি জ্বর ছেড়ে গেছে, অমনি ওষুধ বন্ধ। অথচ অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ডোজ কমপ্লিট না হলে জীবাণুগুলো ওষুধ–সহনীয় হয়ে পড়ে। ফলে অসুখ হলে আর ওষুধ কাজে লাগে না। তা ছাড়া, ডাক্তারদেরও ভুল হয়। হয়তো অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। ফলে ক্ষতি হয়। এখন সারা বিশ্বেই এই সমস্যা। এমন দিন আসছে, যখন কঠিন অসুখের কোনো সহজ চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। তাই অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে এখনই সতর্ক হতে হবে।

সেমিনারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হীল–এর পক্ষ থেকে জেবুন নেসা আমাকে কয়েকটি লিফলেট দিয়ে বলেন, প্রচার করবেন। সেখানে সুস্থ থাকার কয়েকটি সহজ উপায়ের কথা লেখা হয়েছে। তার কিছু অবশ্য আমিও সেখানে আলোচনা করেছি। যেমন ধরুন, দাঁতের যত্নের কথা। আমরা ছোটবেলায় রোজ সকালে প্রথমেই দাঁত মাজতাম। পরে শুনলাম সকালে না, রাতে খাওয়ার পর দাঁত মাজতে হবে। সম্প্রতি জেনেছি, সেটা তো করতে হবেই, উপরন্তু সকালে নাশতার আগেও দাঁত মাজতে হবে। উপরন্তু রাতে খাওয়ার পর ফ্লসিং বা পরিষ্কার সুতা দিয়ে দাঁতের ফাঁকের ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে। তাহলে আর চিন্তা নেই।

রাতে ব্রাশ করার পর মুখের ব্যাকটেরিয়া খুব কমে যায়। ওরা সকালের নাশতার অপেক্ষায় থাকে। নাশতা খাওয়ার পরপরই ব্যাকটেরিয়াগুলো শুধু খায় আর বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এতে যে অ্যাসিড বের হয়, তা দাঁতের এনামেলের বারোটা বাজায়। দাঁতে ফোকর (ক্যাভিটি) হয়, আমরা বলি ‘পোকা ধরে’। তাই আগে ব্রাশ করে নিলে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়ে, ক্ষতির আশঙ্কা কমে। নাশতার পর অবশ্য ভালো করে কুলকুচা করে দাঁতের ফাঁকের ময়লা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সারা দিনে আমাদের মুখে সব সময় প্রচুর লালা থাকে। ফলে লালার ক্যালসিয়াম ব্যাকটেরিয়া–সৃষ্ট অ্যাসিডের ক্ষতির আশঙ্কা কমায়। অবশ্য নাশতার আগে না পরে দাঁত মাজতে হবে, সেটা নিয়ে ভিন্নমতও আছে। ডা. নাভিরা আফতাবি বিনতে ইসলাম আমাকে বললেন, সকালে শুধু পানি দিয়ে কুলি আর নাশতার পর দাঁত ব্রাশ করাই সবচেয়ে ভালো।

সুস্থ থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রতিদিন ব্যায়াম। সকাল বা সন্ধ্যায় মাত্র ১৫-২০ মিনিটের ব্যায়াম শরীর সতেজ ও সুস্থ রাখে।

আসুন, আমরা সবাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হই। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করি।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail. com