ইশতেহার শুধু কথার কথা না হোক

বদিউল আলম মজুমদার
বদিউল আলম মজুমদার

নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ একটি মৌসুমি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শীতের মৌসুমে যেমন দেশে মৌসুমি পাখি আসে এবং শীতের পর চলে যায়, সেভাবে নির্বাচনের মৌসুম এলে নির্বাচনী ইশতেহারের আবির্ভাব ঘটে এবং নির্বাচনের পর ইশতেহারও যেন হারিয়ে যায়। তবু নির্বাচনী ইশতেহার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে সচেতন নাগরিকেরা রাজনৈতিক দলের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে এবং তাঁদের অগ্রাধিকার সম্পর্কে জানতে পারেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল/জোটগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে, তাতে বহু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আছে অনেক চটকদার বিষয়ও। দেখানো হয়েছে অনেক আশার আলো। যেমন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের মধ্যে আছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সৃষ্টি।

বিএনপি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ বহু সুদূরপ্রসারী সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে অঙ্গীকার করেছে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির অবসানের।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অঙ্গীকার করেছে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার। একই সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার। সিপিবি তার ইশতেহারে ‘রুটিরুজি অধিকারের জন্য শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার’ অঙ্গীকার করেছে।

অঙ্গীকারগুলো আকর্ষণীয়। কিন্তু এসবের সার্থকতা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর। ইশতেহার বাস্তবায়নে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সফলতা নেই বললেই চলে। যেমন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশ টিআইয়ের দুর্নীতি সূচকে প্রথম হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘বিদ্যমান সীমাহীন দুর্নীতির’ মূলোৎপাটন করার অঙ্গীকার করে। কিন্তু তাদের শাসনামলে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

একইভাবে ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক একটি যুগান্তকারী নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেছিল। রাষ্ট্রের সব স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডÐবন্ধ, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি নির্মূল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণমুক্ত রাখা, মন্ত্রী-সাংসদসহ ক্ষমতাধরদের বাৎসরিক সম্পদের হিসাব প্রদান, সংসদকে কার্যকর করা ইত্যাদি অঙ্গীকার দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরও অন্তর্ভুক্ত ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও বিকেন্দ্রীকরণকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে আমরা আজ অন্য বাংলাদেশ পেতাম।

এবারের ইশতেহার ঘোষণার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো, অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য জনগণের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান এবং সেসব থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার। আমাদের রাজনীতিবিদেরা সাধারণত ভুলত্রুটি স্বীকার করেন না। এই অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে অন্যদেরও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার আহ্বান জানাই।

প্রধানমন্ত্রী যদি নির্মোহ পর্যালোচনার মাধ্যমে তাঁর সরকারের এখন শোধরানোর মতো গত ১০ বছরের ভুলগুলো চিহ্নিত করেন, তাহলে তাঁর এ স্বীকারোক্তি সার্থক হবে। বিশেষ করে বের করা দরকার ২০০৮ সালে যে মহাজোট সরকার তরুণসহ সমাজের সব স্তরের সমর্থনে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল, ১০ বছর পর তাদের কেন এত শঙ্কাগ্রস্ত মনে হচ্ছে? প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনে কেন তাদের নিয়ন্ত্রণের আলামত দেখা যাচ্ছে?

এবারের বড় ভুল ছিল অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন। কমিশন যেখানে নির্মোহভাবে রেফারির ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ মীমাংসা করে সবার জন্য সমসুযোগ তৈরি করবে, সেখানে এর সদস্যরা নিজেরাই বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। নির্বাচনী মাঠে যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে, তাঁরা সে দিকে তাকাচ্ছেন না। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এটি মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতীতের ভুল এড়ানোর ঘোষণা এর আগেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। তাঁর এবারের ঘোষণা যাতে কথার কথায় পরিণত না হয়, সে লক্ষ্যে আসন্ন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাঁর বড় উদ্যোগ প্রয়োজন। তাঁকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তাঁর দল ও মনোনীত প্রার্থীদের সদাচরণ।

আরেকটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়গুলো ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তা-ভাবনা বইটিতে প্রণিধানযোগ্য কিছু কথা বলেছেন। সেটি উদ্ধৃত করেই লেখাটি শেষ করছি, ‘ “জনগণ ভোট দিক আর না দিক জিততেই হবে” যদি মনোভাব এটাই থাকে তাহলে ভোট চুরি, সন্ত্রাস, কালোটাকা, প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন চলতেই থাকবে...। কোনো সরকার যদি জানে যে নির্বাচনের সময় তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, তাহলে সেই সরকার নির্বাচনের পূর্বে যে সমস্ত ওয়াদা করবে, তা পালন করবে। আর ওয়াদাও যা ইচ্ছা তা করবে না, যত দূর পারবে ততটুকুই করবে। মানুষকে অযথা বিভ্রান্ত করবে না। সরকার পরিচালনায় দুর্নীতি ও কালোটাকা কামাই করবার প্রবণতাও কমতে থাকবে, কারণ ক্ষমতা যখন ছাড়তেই হবে তখন দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়বার সম্ভাবনাও থাকবে।’

* লেখক: সম্পাদক, সুজন
*লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব