খোমেনি ও ফুকো: ৪০ বছর পর

বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে অনিশ্চয়তায় ভরা এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে খামেনির অনুসারীরা
বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে অনিশ্চয়তায় ভরা এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে খামেনির অনুসারীরা

আর কয়েক সপ্তাহ পরই ইরান বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী পালন করবে। কষ্টের সঙ্গেই ইরানিদের উদ্‌যাপনে শামিল হতে হবে। তারা এ মুহূর্তে দৈনন্দিন জীবনযাপনে নিষ্ঠুর ধাঁচের এক সংকটে রয়েছে।

রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব ও গণচীনের বিপ্লবের পর ইরানের রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল গত শতাব্দীর বড় এক তাত্পর্যবহ ঘটনা। মস্কোতে কমিউনিস্টরা ২৮ বছর আগে ক্ষমতা থেকে অপসারিত। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি থাকলেও সমাজতন্ত্র নেই আর। কিন্তু ইরানে আয়াতুল্লাহরা টিকে আছেন। বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে তাদের অবস্থান এখন ১৮৯ দেশের মধ্যে ৬০—তুরস্ক, চীন ও ভারতেরও ওপরে।

শুধু ইরানের সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই নয়, তেহরানের প্রভাবের পরিধি বাড়ছে ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবানন পর্যন্ত। প্রায় চার দশক অবরোধের মধ্যে থেকেও তাদের সামর্থ্যের বিস্তৃতি বিস্ময় জাগায়। তবে বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে অনিশ্চয়তায় ভরা এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে খামেনির অনুসারীরা।

ইরান এ মুহূর্তে ডলারকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার প্রায় বাইরে। তারা অদৃষ্টপূর্ব এক অর্থনৈতিক যুদ্ধের মুখোমুখি। তাদের সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ কিংবা লেবাননের হিজবুল্লাহকে সহায়তা দেওয়া কমাতে হবে। এ ছাড়া আসন্ন মাসগুলোতে দেশটিতে বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের ব্যাধিগুলো, শুরু থেকে যার প্রধান শিকার নারী ও সুন্নি সংখ্যালঘুরা। 

দুই.

ইরানে এই মুহূর্তে যাঁরা বিপ্লবের দিনগুলো ভালোভাবে স্মরণ করতে পারেন, তাঁদের বড় অংশ ৫০ পেরোনো মানুষ। তেহরানে এ রকম মানুষের স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল দিন ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি। শত শত বছরের রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের শেষ উত্তরাধিকার মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি ৩৮ বছরের শাসন ছেড়ে পালিয়েছিলেন সেদিন। এর ১৪ দিন পর ১ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের নির্বাসন শেষে সাইয়েদ রুহুল্লা মুসাভি খোমেনি এয়ার ফ্রান্সের ৪৭২১ নম্বর ফ্লাইটে করে তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে নামেন। এর ঠিক ১০ দিন পর শাহর সেনাবাহিনী মেনে নিতে বাধ্য হয়—ইরানে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এরও ১৭ মাস পর মিসরে রেজা শাহর মৃত্যু হয়।

বিপ্লবের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইরানের জনমানসে অধিক শত্রুভাবাপন্ন দেশ ছিল যুক্তরাজ্য। তেলসম্পদ নিয়ে ঐতিহাসিক বিরোধ ছিল রেষারেষির মূলে। তবে ১৯৭৯ থেকে ক্রমেই যুক্তরাজ্যকে হটিয়ে ওয়াশিংটন ইরানের প্রধান প্রতিপক্ষের আসনটি নিয়ে নেয়। গত নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে ইতিহাসের কঠোরতম অর্থনৈতিক অবরোধ কার্যকর করেছে ওয়াশিংটন। তেল বিক্রি, সমুদ্র–বাণিজ্য, ব্যাংকব্যবস্থা—সবই নিষেধাজ্ঞার শিকার। ইরানকে নতজানু করার জন্য গত ৪০ বছরে ওয়াশিংটনের তৃতীয় উদ্যোগ এটা।

ইরানের রাজস্ব আয়ের ৮০ শতাংশ উৎস যে পণ্য, সেই তেল বিক্রির সুযোগ একেবারেই বন্ধ করে দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর যা ছিল দৈনিক ২৩ লাখ ব্যারেল, এখন তা অন্তত ১০ লাখ ব্যারেল কম। স্বভাবত রাষ্ট্রীয় আয় কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগও কমছে। সাধারণ ইরানিদের জীবনে তার নেতিবাচক ছাপ পড়বে বহুভাবে। দেশটির প্রতিরক্ষা সামর্থ্যেও এর ছাপ পড়তে বাধ্য। তার সঙ্গে মিলিয়েই যেন ইরানের অভ্যন্তরে ‘জুনদাল্লাহ’, ‘আইএস’ এবং ‘আনসার আল-ফোরকান’-এর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা বেড়েছে ইদানীং।

১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরানিদের গড় আয় বেড়েছিল ৬৮ শতাংশ। গড় আয়ু ৫৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ বছর। কঠোরতর অবরোধে পড়ে এসব অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত হবে। সংকটের অনিবার্য ছাপ পড়বে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও, যা ছিল অনেকটা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে দেশটি ইতিমধ্যে আমদানি অনেক কমিয়েছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে তুর্কি ও রুশদের সঙ্গে সীমান্ত চোরাচালানই শেষ ভরসা।

ওয়াশিংটনের চাওয়াটি স্পষ্ট। ইরানের মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে রাস্তায় নেমে বিদ্রোহ করুক এবং আয়াতুল্লাহদের পতন ঘটাক। কিন্তু দফায় দফায় অবরোধ শাসকগোষ্ঠীর রক্ষণশীল ধারাকেই শক্তিশালী করছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-সৌদিদের যুদ্ধংদেহী ভূমিকা ইরানে সংস্কারপন্থীদের সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি নির্বিঘ্নে তাঁর পদে আছেন ৩০ বছর। ইরানের ভেতরকার এই দ্বন্দ্বকে দেশটির ‘আধ্যাত্মিকতার রাজধানী’ কৌম শহরের আয়াতুল্লাহদের সঙ্গে তেহরানকেন্দ্রিক তারুণ্যের চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতীকী দূরত্ব আকারেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কৌম ছিল ১৯৭৯ বিপ্লবের সূতিকাগার। তেহরান হয়ে আছে পরিবর্তনের সম্ভাব্য স্ফুলিঙ্গ। আপাতত এই দুয়ের ভারসাম্যে দেশটি টিকে আছে।

ইরান পুরোদস্তুর এক ধর্মীয় রাষ্ট্র, যার বিশ্বাসের মর্মে আছে শিয়া মতাদর্শ। কিন্তু কৌম ও তেহরান কেউ কারও ওপর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে চাইছে না। মোল্লারা কমিউনিস্ট তুদেহ পার্টিকেও আবার কাজ করতে দিচ্ছে। বিপ্লবের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮২ সালে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে রুশদের দেখা যাচ্ছে ইরানের বড় এক কৌশলগত মিত্র হিসেবে। তুদেহ পার্টি নিষিদ্ধ করার সময় রাশিয়াকে ইরান ষড়যন্ত্রকারী জ্ঞান করত। 

তিন.

ইরান বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর কথা বিশেষভাবে মনে আসে। ফুকো ইরান বিপ্লবের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে দুবার তেহরান গিয়েছিলেন। অন্তত ১৫টি নিবন্ধ লেখেন তখনকার ইরান নিয়ে। একই বিষয়ে তাঁর অনেক সাক্ষাৎকারও আছে। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে ফুকো যখন তেহরান পৌঁছান, তার দুই দিন আগেই শাহর বাহিনী ৮৮ জন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে। কিন্তু ইরানে ‘ভয়ের অনুপস্থিতি’ এবং অসাধারণ এক ‘সম্মিলিত ইচ্ছা অভিপ্রকাশ’ দেখে ফুকো মুগ্ধ হয়েছিলেন। সম্মিলিত ইচ্ছার এই রাজনৈতিক প্রকাশকে তিনি অভিহিত করেন এমন এক ‘ঈশ্বর’ বা ‘আত্মা’ হিসেবে, যাকে মোকাবিলা করা দুরূহ। শিয়া মতাদর্শের সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকার পণ্ডিত আলী শরিয়তির বিশেষ প্রভাব ছিল ফুকোর ওই দার্শনিক অভিযানে।

ইরান বিপ্লব নিয়ে ফুকোর উচ্ছ্বাস তখনকার বামপন্থী জগতে বিশাল বিস্ময় ছিল। ফুকো ‘মৌলবাদ’ বা ‘ইসলামি’ তকমায় না ফেলে ‘অন্তহীন ইতিহাসের এক বর্তমান প্রকাশ’ হিসেবে ইরানকে বুঝতে চাইছিলেন। খোমেনির ‘আধ্যাত্মিকতার রাজনীতি’র ভবিষ্যৎ নিয়ে ফুকো আশাবাদী ছিলেন। নতুন রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই ‘নবতরঙ্গ’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দিগন্ত পাল্টে দেবে বলে তিনি মনে করতেন। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের পরিস্থিতি হয়তো তাঁর অনুমানের সাক্ষ্য এখন। ফুকো পাশ্চাত্যের বৈশ্বিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইরান বিপ্লবকে প্রথম বড় ধরনের অভ্যুত্থান হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু বিপ্লবোত্তর ইরানের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপগুলো ফুকোর অনেক আশাবাদকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিপ্লবের এই পরিণতি কতটা খোমেনিবাদের কারণে আর কতটা যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক যুদ্ধ জারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই।

তবে ফুকোর এই ভবিষ্যদ্বাণী খুবই সংগত যে, ইসলামের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে ইরানকে বোঝা যাবে না। এই বিপ্লব পশ্চিমা উদারতন্ত্রের বিপক্ষে মোল্লাতন্ত্রের অভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। শিয়া মতাদর্শের সমাজতান্ত্রিক উপাদান ও পারস্য সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যের জায়গা থেকেই শুধু এর সমাজতত্ত্ব খানিকটা বোঝা যায়। রাজনীতি, দল ও ধর্ম—এই তিন প্রত্যয় পশ্চিমে পৃথক, কিন্তু শিয়া মতাদর্শে ঠিক উল্টো। নেতা হিসেবে রুহুল্লাহ খোমেনির উত্থান ও মৃত্যুর ৩০ বছর পরও তাঁর বিপ্লব টিকে যাওয়ার অনেক কার্যকারণই তাই বাকি দুনিয়া আজও বুঝতে অক্ষম।

ইরানে আয়াতুল্লাহরা ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সাধারণভাবে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি কিংবা ভোগবিলাসে মত্ত হননি। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা নিজেদের জন্য সুযোগ-সুবিধার আলাদা জগৎ তৈরি করেননি। কিন্তু ইরান আপাদমস্তক কর্তৃত্ববাদী এক রাষ্ট্র। সম্পদের শিয়াবাদী সুষম ব্যবস্থাপনা এত দিন সেখানে মানুষকে রাস্তায় নামতে আগ্রহ জোগায়নি, অবরোধের যন্ত্রণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তা পারবে কি না, সেটা এখন দেখার বিষয়।

আলতাফ পারভেজ, ইতিহাস বিষয়ের গবেষক