কংগ্রেসের ফিরে আসা

চলতি মাসে ভারতের তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের বিজয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য একটি বড় ধাক্কা। নির্বাচনের এই ফলাফল নাটকীয়ভাবে মোদির সমর্থকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে উড়িয়ে দিয়েছে যে তিনি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত মে মাসের নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য সহজে পুনর্নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি সরকারের পরাজয়টা আসলে মেনে নেওয়ার মতো নয়। কারণ, এসব রাজ্য ছিল বিজেপির মূল ঘাঁটি। নির্বাচনের এই ফলাফলে বোঝা যায়, নয়াদিল্লি এবং রাজ্যগুলোতে বিজেপির পারফরম্যান্সের ব্যাপারে জনগণের মোহমুক্তি ঘটেছে এবং যে কংগ্রেস দলকে দুর্বল ভাবা হতো, সেটাই এখন জনগণের আস্থা অর্জন করেছে।

বিজেপির পরাজয়ের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে কৃষি খাতকে অবহেলা করা, যার ওপর ৬০ শতাংশ ভারতীয় এখনো তাঁদের জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, কৃষিঋণ দেওয়া এবং মওকুফ করা নিয়ে কেন্দ্রের নীতি প্রশ্নবিদ্ধ। ফসল ফলানোর ব্যর্থতার পাশাপাশি ফসলবিমা স্কিমগুলোর ব্যর্থতা, যা ঋণগ্রহীতাদের চেয়ে বরং বিমাকারীদের উপকৃত করেছে, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি না করা, কৃষিতে সেচসহ অন্যান্য বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া এবং কৃষক আত্মহত্যার ঘটনায় রেকর্ড সৃষ্টি—এ সবকিছু বিজেপির পরাজয়ে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা ভারতের বেশির ভাগ স্থানেই একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই দুর্দশার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূলত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে দায়ী করা হয়। রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের ঠিক আগে আগে দেশের হাজার হাজার কৃষক তাঁদের সমস্যা সমাধানের দাবি নিয়ে রাজধানী নয়াদিল্লিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।

বিজেপির অন্যান্য ভুল নীতিও তাদের প্রতি জনসমর্থন কমে যাওয়ার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ২০১৬ সালে মোদি সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন নোটবন্দীর পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এতে ভারতের জিডিপির হার কমেছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। গ্রামীণ দরিদ্র শ্রমজীবীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দরিদ্র কৃষিশ্রমিকেরা আর কখনোই তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত অনেক ক্ষুদ্রশিল্প এই নোটবন্দী পদক্ষেপের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলো আর খোলেনি। ফলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন।

বিজেপির পরাজয়ের তৃতীয় বড় কারণ হলো বেকারত্বের সমস্যা। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি প্রতিবছর ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। কিন্তু মোদির সরকার গত চার বছরে ১৫ লাখ মানুষের কর্মের সংস্থান করতে পারেনি।

দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের দিকে যথাযথ নজর না দেওয়া বিজেপির পরাজয়ের আরেকটি কারণ। দলিতদের উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বিজেপি। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ করতে ১৯৮৯ সালে প্রণীত একটি আইনের কিছু বিধান পরিবর্তন করাকে কেন্দ্র করে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ছত্তিশগড়ে উন্নয়নের নামে রাজ্য সরকার আদিবাসীদের জমি দখল করলে তা তাঁদের মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়। রাজস্থানের দলিতদের প্রতিনিয়ত নানা অবমাননার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর এর প্রতিশোধ তাঁরা নিয়েছেন বিজেপিকে ভোট না দিয়ে। বিজেপির জন্য এই নির্বাচনের ফলাফল সত্যিই একটি বড় ক্ষত সৃষ্টি করেছে।

এখন এই ক্ষত সারানোর জন্য এবং নয়াদিল্লিতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিজেপিকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী ধরনের প্রচারণা তারা চালাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি মনে হয় এবার কাজ করবে না। এখন জনগণের মন পেতে তারা দুটি কৌশল অবলম্বন করতে পারে। একটা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কায়দায় প্রচারণা চালানো। আরেকটি হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার-প্রচারণা বেশি করে চালানো, যা বিপজ্জনক হিন্দুত্ব মতবাদের ওপর নির্ভর করে বিজেপি এর আগেও চালিয়েছিল। ভারতের সংখ্যালঘুদের অপমান করে বা বঞ্চিত করে বিজেপি হয়তো স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। কিন্তু এটা ভারতের মতো বহুজাতিক সমাজে দীর্ঘ মেয়াদে বিপদ ডেকে আনবে।

ভারতীয়রা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এমন একটি সরকার চান, যে সরকার দেশের সব নাগরিককে সমান গুরুত্ব দেবে। বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফলে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে যে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে বিজেপির চেয়ে কংগ্রেস অনেক এগিয়ে রয়েছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী থারুর, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী