বিএনপির অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনা দরকার

হারুন–অর–রশিদ
হারুন–অর–রশিদ
৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী পরিস্থিতি, ইশতেহার, ভবিষ্যৎ সরকার গঠন—এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন–অর–রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান


প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বর কি সহিংসতার আশঙ্কা করছেন?

হারুন-অর-রশিদ: ইতিমধ্যে যদিও দু-চারজনের প্রাণহানি ঘটেছে। একটি প্রাণও মূল্যবান। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনে কিছুটা সহিংসতা ঘটে। কিন্তু এবারে নির্বাচন হবে উৎসবমুখর পরিবেশে। সারা দেশে এ পর্যন্ত যতটা সহিংসতা ঘটেছে, তাকে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। এটা সহনশীল গণ্ডির মধ্যেই রয়েছে।

প্রথম আলো: সিইসি বলেছেন মাঠ সমতল, মাহবুব তালুকদার বলেছেন মাঠ সমতল নেই।

হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচন কমিশনে আমরা ৪: ১ অনুপাতে বিভক্তি লক্ষ করি। জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের ভিন্নমত যদি থাকে তাহলে তাঁরা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তা লিপিবদ্ধ করতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে ডেকে বলা কাম্য নয়। ১০ বছর পরে বিএনপি যেখানে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সেখানে সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রথম আলো: কী কারণে ভাবেন মাঠ সমতল?

হারুন-অর-রশিদ: সামরিক রাষ্ট্রপতি, সামরিক ফরমান এলএফওর মধ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলিনি। বঙ্গবন্ধু কখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলেননি। বাংলাদেশের সামরিক শাসনামলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলা হয়নি। ১৯৯১ সালের পর থেকে আমরা অতিমাত্রায় এটা উচ্চারণ করছি। তিন কারণ মুখ্য। প্রথমত, বিএনপিই তার অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা মাঠ বিঘ্নিত করেছে। দ্বিতীয়ত, লাল কার্ডধারীদের নিয়ে তারা নিজেরাই অসমতল মাঠে খেলতে নেমেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন দণ্ডপ্রাপ্ত। দলটির দণ্ডিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসিত। ২০১৪ সালে তারা শুধু নির্বাচন বয়কটই করেনি, সারা দেশে তারা সন্ত্রাস করেছিল। মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। ২০১৫ সালে তারা আগুন–সন্ত্রাস করেছে। এই কারণে তাদের অনেক নেতা-কর্মী আসামি হয়েছেন। কেউ হুকুমের আসামি হয়েছেন। তৃতীয়ত, তারা ব্যাপকভাবে জনগণের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত ১০ বছরে তারা যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন করতে পারল না, সেটা কি শুধু সরকার ও পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে বলেই? এটা কি কোনো কথা হতে পারে? ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ কীভাবে ছয় দফা দিবস পালন করেছিল? জনগণের মধ্যে আপনার যদি সমর্থন থাকে, সরকারি প্রশাসনযন্ত্র কিন্তু আপনাকে ততটা বাধা দিতে পারে না। বাধা দিলেও তারা অতিক্রম করতে পারে।

প্রথম আলো: অভিযোগ হলো সরকার এই অসম মাঠকে আরও অসমতল করার কোনো চেষ্টা বাদ রাখেনি। গত ১০ বছরে দেশে কি দুর্নীতি হয়নি, যেখানে কারও দণ্ড হয়েছে, আর তা তাঁদের ভোটে অযোগ্য করেছে?

হারুন-অর-রশিদ: এটা কিন্তু এক অর্থে ঠিক নয়। টাঙ্গাইলের একজন সংসদ সদস্য কারাগারে।

প্রথম আলো: তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা খুনের আসামি। তদুপরি তাঁরই পরিচয়সূত্রে তাঁর পিতাকে দেওয়া হয়েছে? এটা পুরস্কার নয়?

হারুন-অর-রশিদ: সেটা পুরস্কার নয়। যদি সেটা বলেন, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো: রাজধানীসহ দেশের কিছু স্থানে ধানের শীষের পোস্টার চোখে কম পড়ে অথবা পড়ে না। বিএনপি এতটাই জনবিচ্ছিন্ন যে তারা পোস্টার পর্যন্ত লাগাতে পারে না?

হারুন-অর-রশিদ: শুনেছি এটা তারা একটা কৌশলের অংশ হিসেবে নিয়েছে। সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরে তারা সক্রিয় হবে। প্রশ্ন হলো, নেই কেন? তারা পোস্টার লাগাচ্ছে কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে? এ রকম অভিযোগ কী কী আছে? এটা তো সাধারণ দৃশ্যপট হিসেবে নেওয়া যাবে না।

প্রথম আলো: কিন্তু আপনি পাইকারি মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলার বিষয়ে কী মন্তব্য করবেন?

হারুন-অর-রশিদ: মিথ্যে মামলা যদি দায়ের করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। গায়েবি মামলা, মিথ্যা মামলা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ঘটনা সত্যি যদি থাকে এবং নাশকতামূলক অভিযোগ থাকে, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তাদের থামানো যাবে না। আপনার ভুলের কারণে ১৩ প্রার্থী বাতিল হয়েছে, আপনি এখন মাঠ অসমতল বললে হবে?

প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বর ঝুলন্ত পার্লামেন্ট আশা করেন?

হারুন-অর-রশিদ: না, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটবে।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে চেয়েছে বিএনপি।

হারুন-অর-রশিদ: আমি এর দরকার আছে মনে করি না। কারণ ব্রিটেনের রানি যেভাবে চলেন, সেভাবে বাংলাদেশি রাষ্ট্রপতি চলেন। রানিকে ক্ষমতা দেওয়ার দাবি সেখানে ওঠে না।

প্রথম আলো: অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, অন্তত ৫০টির নিচে আসন নিয়ে বিএনপির পক্ষে বিরোধী দলে বসা সম্ভব হবে না। তারা সংসদে থাকবে না।

হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচনে অংশ নিলেন কিন্তু জনগণ কত আসন আপনাকে দেবে, সেটা তো কোনো দল বা সরকার নির্ধারণ করবে না। জনগণ ভোট দেবে। একটি গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল আবশ্যক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একা বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। তাঁকে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল। সুতরাং সংখ্যা বড় কথা নয়, সংখ্যা কম হলেও বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যদি তারা দায়িত্বশীল হয়। যদি তারা জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখে। যদি তারা কথায় কথায় ওয়াকআউট এবং বয়কট না করে।

প্রথম আলো: নির্বাচনী ইশতেহারগুলো সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?

হারুন-অর-রশিদ: আমি সবগুলো দলের ইশতেহার দেখেছি। সেখানে একটা বিষয় এসেছে, সবাই বলেছেন আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাই না। আমরা এখন সহনশীলতার মধ্যে আসতে চাই। এখন উদাহরণ তৈরি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে গ্রহণ করুন। ইশতেহারে ভারতের নাম না নিলেও বিএনপি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলেছে। এর অর্থ ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি থেকে তো তারা বেরিয়ে এসেছে। ওখান থেকে তারা যদি সরে আসতে পারে, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে মানতে বাধা কোথায়? বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশ হতো না।

প্রথম আলো: তাহলে নতুন সংসদেও কি দা-কুমড়া সম্পর্ক চলবে?

হারুন-অর-রশিদ: স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মানতে অসুবিধা কোথায়। পারস্পরিক দূরত্ব ঘোচাতে এসবই সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আপনারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। ইনডেমনিটি বিল পাস করেছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেছেন। এখন যদি বলেন ঐক্য হচ্ছে না কেন, মডারেশন হচ্ছে না কেন, আমরা আত্মার সঙ্গে আত্মা মিলাতে পারছি না কেন? কেমন করে মিলবে? আজ যেটা দরকার তা হলো আত্মসমালোচনা, উপলব্ধি ও আত্ম অনুশোচনা। আজকে তাদের সময় এসেছে নতুন শপথ নেওয়ার। আমরা কোনো অবস্থাতেই কোনো অসাংবিধানিক পথে যাব না। সহিংস এবং নাশকতার পথে যাব না। জাতীয় সংসদে পাঁচজন গেলেও আমরা ন্যায্য কথা বলব।

প্রথম আলো: আপনি ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেন। সেখানে বিরোধী দলের নেতা ছায়া প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার আসনে। বিএনপি বিরোধী দলে গেলে আপনি ছায়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে দেখতে চান?

হারুন-অর-রশিদ: আপনার মতো এটা আমারও জিজ্ঞাস্য। আপনার কাছে জানতে চাই কে হবেন?

প্রথম আলো: সরকার না করতে পারলে বিএনপিই বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে?

হারুন-অর-রশিদ: সেই সম্ভাবনা আছে। তবে আপনি জাতীয় পার্টির সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করতে পারেন না।

প্রথম আলো: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও আমরা ২০১৪ সালের মডেলের পুনরাবৃত্তি ২০১৯ সালেও দেখতে পারি?

হারুন-অর-রশিদ: আমি এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেব না। ধরুন কথার কথা, যদি জাতীয় পার্টি বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে যায়, তখন তো জাতীয় পার্টির লিডার অব দ্য অপজিশনের পথে চলে যাবে। তবে বিরোধীদলীয় নেতার আসন জাতীয় পার্টি ও বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটাও বলব, বিএনপির সম্ভাবনাই বেশি।

প্রথম আলো: নির্বাচনের পরে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য কীভাবে টিকতে পারে?

হারুন-অর-রশিদ: কামাল হোসেনের ক্ষমতার রাজনীতিতে থেকে নির্বাচন না করাটা বিস্ময়কর ছিল। কারণ, তিনি যে গান্ধীজি স্টাইল নিয়েছেন, সেটা তো রাজনীতিতে অচল। নেহরু-প্যাটেলরা টিকেছেন। গান্ধী টিকতে পারেননি। নির্বাচনের পরে আপনি দেখবেন, একটি নতুন চিত্র সামনে চলে এসেছে। দেখবেন এই নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। আর সেটা হবে ইতিবাচক। এবারের নির্বাচনে বিএনপির হারানোর কিছু নেই, জয় করার আছে বিশ্ব। বিএনপির এখন অবস্থান হচ্ছে খাদের গভীরে। সেখান থেকে বিএনপির উঠে আসার এটা হচ্ছে শেষ সুযোগ। বিএনপির নিজেকে সমন্বয় করতে হবে। সংখ্যার বিচার না করে, তারা যেন গঠনমূলক রাজনীতিতে নিজেদের সীমিত রাখে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হারুন-অর-রশিদ: ধন্যবাদ।