নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে চাই : শারমিন মুরশিদ

>
শারমিন মুরশিদ
শারমিন মুরশিদ
শারমিন মুরশিদ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো: নির্বাচন চলেই এসেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে খুব স্বাভাবিক নির্বাচনী পরিবেশ বলা যাচ্ছে না। হাতে সময় আর নেই বললেই চলে। এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির কতটুকু উন্নতির আশা করছেন?

শারমিন মুরশিদ: আমাদের শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছে। ফলে আমরা দেখতে চাই যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ও শান্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। সে কারণে আশাবাদের ওপর ভরসা রাখাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

আমরা সবাই জানি যে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের একধরনের ভরসা ও আস্থা কাজ করে। অতীতে আমরা নির্বাচনের সময় সেনবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। কিন্তু বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী কোনো নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী কিছু করতে পারবে না। ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিসির তরফে ভূমিকা পালনের জন্য নির্দেশনা লাগবে। এমন একটি কাঠামোর মধ্যে থেকে সেনাবাহিনী কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারবে, তা এক বড় প্রশ্ন। অনুমতি নিয়ে ও নির্দেশের অপেক্ষায় থেকে কাজ করতে গেলে ঘটনা যা ঘটার তা ঘটে যাবে। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে মোতায়েন করা হয়েছিল। ফলে সেনাবাহিনীর ওপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন সেনাবাহিনীর ওপর কমিশনের কমান্ড নেই। ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিসিদের জন্য বসে থাকতে হবে।

প্রথম আলো: বর্তমান পরিস্থিতিতে কেমন নির্বাচন আশা করছেন?

শারমিন মুরশিদ: মাঠপর্যায় থেকে যেসব খবর পাচ্ছি ও যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি রয়েছে। আমাদের সংগঠন ব্রতী তরুণদের নিয়ে কাজ করে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের জানাচ্ছেন যে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে তঁারা ভয়ের মধ্যে আছেন। আসলে ঢাকায় থেকে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি না। কেমন হবে নির্বাচন—এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সবকিছু মিলিয়ে আমরা একধরনের সংশয়ের মধ্যে রয়েছি।

প্রথম আলো: এই বাস্তবতা দূর করতে এই মুহূর্তের করণীয় কী?

শারমিন মুরশিদ: এখন নির্বাচন কমিশনকে এমন বলিষ্ঠ বার্তা দিতে হবে, যাতে জনগণের মধ্যে ভয় ও সংশয় কেটে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ রাখতে হবে। আমি আবারও ২০০৮ সালের নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দিতে চাই। তখন কমিশন নানা কর্মসূচি নিয়েছিল। এতে কমিশনের সঙ্গে জনগণের একটা সম্পৃক্ততা গড়ে উঠেছিল। আস্থার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। এবার তা হয়নি। নির্বাচনের আগে হাতে সময় আছে আর মাত্র তিন দিন। ফলে কমিশনকে এমন বার্তা দিতে হবে, যাতে জনগণের মধ্যে ভোটের ব্যাপারে আস্থা তৈরি হয়।

প্রথম আলো: আপনাদের প্রতিষ্ঠান তো নির্বাচন পর্যবেক্ষণসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়িত। ৩০ তারিখের নির্বাচনে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

শারমিন মুরশিদ: আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য এবার আমরা অনুমোদন পাইনি। এতে আমরা খুবই অবাক হয়েছি। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেখানে আমাদের কার্যক্রম রয়েছে, সেখানে স্বল্প পরিসরে আমরা আমাদের মতো করে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করব। আগেই বলেছি যে আমরা তরুণদের নিয়ে কাজ করি। আমরা তরুণ ভোটারদের গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছি। তঁারা তঁাদের তথ্যগুলো লিখে রাখবেন। যেমন তাঁরা ভোট দিতে যাচ্ছেন কি না, ভোট দিতে পারলেন কি না, না পারলে কেন পারলেন না—এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এসব তথ্য আমাদের গবেষণার কাজে লাগবে।

প্রথম আলো: আপনাদের প্রতিষ্ঠান কি এই প্রথম নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো?

শারমিন মুরশিদ: এবারই প্রথম আমাদের অনুমতি দেওয়া হলো না। আসলে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে কাজ করার কথা। কারণ, দুই পক্ষের লক্ষ্যই এক। আগে বিষয়টি এত আনুষ্ঠানিক ছিল না। এখন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ওপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দেশে সরকারি দল বা বিরোধী দল নানা তালিকা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যায়। একে রাখা যাবে না, একে বাদ দিতে হবে—এসব অনুরোধ করে আসে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আমাদের বিরুদ্ধে এক পক্ষ কমিশনে বলে এসেছিল। কিন্তু কমিশন তাদের কথা শোনেনি। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের যে গাইডলাইন রয়েছে, আমাদের প্রতিষ্ঠান তা মেনে চলে এবং আমরা তাদের সঙ্গে নিবন্ধিত। আর একই সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কর্মীদের গাইডলাইন ঠিক করি। এরপরও আমাদের অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর।

প্রথম আলো: নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এবার গাইডলাইন কঠোর করা হয়েছে। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল একই কাজ হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?

শারমিন মুরশিদ: সংবাদমাধ্যম ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক—দুই পক্ষের জন্যই এবার গাইডলাইন কঠোর করা হয়েছে। ২০০৮ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, সেবার শুধু ভোটারদের মোবাইল ফোন নিয়ে কেন্দ্রে ঢোকা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, অনেকে ব্যালট পেপারের ছবি তুলতেন কাকে ভোট দিয়েছেন তার প্রমাণ হিসেবে। কিন্তু সাংবাদিক বা পর্যবেক্ষকদের ক্ষেত্রে এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এবার এসব বিধান কঠোর করার ফলে নজরদারি কম হবে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমি মনে করি, সাংবাদিকদের ওপর যে বাড়তি বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো, তা শিথিল করা প্রয়োজন এবং সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রথম আলো: এবারের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও কার্যক্রমকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

শারমিন মুরশিদ: এবারের নির্বাচন কমিশনকে অনেকটা অপ্রস্তুত মনে হয়েছে। প্রস্তুতিতে যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনি নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। কমিশনের কনফিডেন্সের অভাবও লক্ষণীয়। কমিশন এমন অনেক কাজ করেছে, তা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছে অথবা অপরিপক্বতার কারণে করেছে।

প্রথম আলো: এবারের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও তো সেভাবে আসতে দেওয়া হলো না...

শারমিন মুরশিদ: বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে তা যদি আমরা বিদেশিদের দেখাতে না চাই বা উন্মুক্ত করতে না চাই, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্ন উঠবে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষকেরা বিভিন্ন নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে এসেছেন। এবার কী ঘটনা ঘটল যে তাদের অনেকেই অনুমতি পেল না। এর ফলে বিদেশিদের মনে এই ধারণা জোরালো হবে যে এই নির্বাচনে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচনে যে দল নির্বাচনে জয়ী হয় আর যে দল পরাজিত হয়, নির্বাচন নিয়ে তাদের কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী অবস্থান শুনতে হয়। ফলে নির্বাচনটি কেমন হয়েছে, সে ব্যাপারে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মন্তব্যের গুরুত্ব আছে। পর্যবেক্ষকেরা আসতে না পারায় এবারের নির্বাচন প্রশ্নের মুখে পড়বে।

প্রথম আলো: ভোটারদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে?

শারমিন মুরশিদ: আমরা নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ, জনগণ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে। আমরা আশা করছি কমিশন এমন কিছু কথা বলবে ও উদ্যোগ নেবে, যাতে ভোটাররা ভোট দিতে যেতে ভরসা পাবেন। আর ভোটারদের উদ্দেশে বলি, যদি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন যে আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে ফিরে না এসে সেখানকার নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করুন এবং টেন্ডার ভোট দিন। সেই ভোট সাধারণ ভোটের সঙ্গে গণনা করা হবে না, কিন্তু অন্তত রেকর্ড থাকবে যে কতজন ভোট দিতে এসে ভোট দিতে পারেননি। এবং সেগুলো জাল ভোট হিসেবে পড়েছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

শারমিন মুরশিদ: ধন্যবাদ।