নিশ্চিত হোক সবার ভোটাধিকার

মনে হচ্ছে যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আমরা আবার সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন পেতে যাচ্ছি। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য একটি আশার সংবাদ। একানব্বই থেকে যে গণতন্ত্রের পথে আমরা যাত্রা করেছিলাম, তার বিকাশ বিঘ্নিত হয়েছে আমাদেরই রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতায়। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকারিতা অর্জন করতে পারেনি। এমনকি আমাদের ভোটাধিকারও নিশ্চিত হয়নি।

সব দলের অংশগ্রহণই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণের একমাত্র মাপকাঠি নয়। সব রাজনৈতিক দলের সম-অংশগ্রহণের জন্য মুক্ত ও অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করা একটি বড় নির্ণায়ক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হলো দল-মত-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। একই সঙ্গে ভোট গ্রহণ থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ই যে কারসাজিমুক্ত, সে সম্পর্কে জন–আস্থা। অর্থাৎ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার বড় মাপকাঠি হচ্ছে এই ‘পাবলিক পারসেপশন’। জনগণের মধ্যে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও পরিবেশ নিয়ে আস্থার ঘাটতি থাকে, তাহলে আইনগতভাবে বৈধ এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনও গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়। যার ফলাফল সাধারণত উৎসবের পরিবর্তে আতঙ্ক এবং দ্বন্দ্ব-হানাহানি ও অশান্তি।

এবারের নির্বাচন পরিচালনাকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করা। উন্নত গণতন্ত্রে এটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এমন আস্থা অর্জনের সুযোগ আমাদের রাজনীতি আমাদের দিতে পারেনি। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা জয়ী হলেও, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে বিএনপি একটি একতরফা নির্বাচন করেছিল, যা একটি অত্যন্ত স্বল্পায়ুর সংসদ উপহার দিয়েছিল। আবার ২০১৪ সালে এমন আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার প্রায় নির্বিঘ্নে মেয়াদ পূর্ণ করলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনৈতিক ও পর্যবেক্ষক মহলে ব্যাপক অস্বস্তি বিরাজ করেছে। কাজেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে ‘পাবলিক পারসেপশন’কে পাল্টে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়েই এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

প্রাক্‌-নির্বাচনী এই সময়ে কৌশল ও শক্তিমত্তার দিক দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে যোজন দূরত্বে এগিয়ে আছে। একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলই হয়তো আবার ক্ষমতায় আসছে, এমন একটি পারসেপশন তারা জনমনে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তবে এই পারসেপশন সৃষ্টিতে সফলতা আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়েও দেখা দিতে পারে। এটি ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে প্রতিটি ভোট নিশ্চিত করার মরিয়া তাগিদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের দমনে গণহারে মামলা ও গ্রেপ্তারের কৌশল এ পারসেপশন তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ‘গায়েবি’ মামলা বলে একটি নতুন শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে আদালত চত্বর ও মিডিয়া হয়ে মানুষের মুখে মুখে, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য থেকে। হলফনামায় মহাজোটের মোট ২৯৯ প্রার্থীর মধ্যে ১২১ জনের (৪০.৪৭ শতাংশের) বিরুদ্ধে অতীতে ৫২৪টি মামলা ছিল। তার বিপরীতে ঐক্যফ্রন্টের চূড়ান্ত মনোনীত মোট ২৮৭ প্রার্থীর (যার থেকে এরই মধ্যে কয়েকজন আদালতের নির্দেশে বাদ পড়েছেন) ১৪৮ জনের (৫১.৫৭ শতাংশের) বিরুদ্ধে অতীতে ৫৫৯টি মামলা ছিল। পক্ষান্তরে বর্তমানে মহাজোটের মাত্র ২০ জন (৬.৬৯ শতাংশ) প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাত্র ৩৪টি মামলা রয়েছে। তার বিপরীতে ঐক্যফ্রন্টের ১৭৭ জন (৬১.৬৭ শতাংশ) প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে ২ হাজার ৫৬২টি মামলা রয়েছে।

মহাজোটের বিজয়ের পারসেপশন সৃষ্টির ক্ষেত্রে মামলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হামলা। ১০ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু থেকে ঐক্যফ্রন্টের ৫৩ জন এবং আওয়ামী লীগের ২ জন প্রার্থীর গাড়িবহর ও প্রচারণায় বিভিন্ন ধরনের হামলা হয়েছে। এসব হামলায় এ পর্যন্ত ২ জনের মৃত্যুসহ ১ হাজার ১৬০ জন আহত হয়েছেন, যার অধিকাংশই ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মী (দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮)। প্রথম আলোর (২৯ ডিসেম্বর ২০১৮) আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ দিনে ১৮৯টি আসনে ২৫০টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এসব হামলার ঘটনা সঠিক নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে পর্বতপ্রমাণ বাধা সৃষ্টি করেছে। এবারের এসব হামলার একটি নতুন উপসর্গ হচ্ছে স্বয়ং প্রার্থীদের আক্রান্ত ও আহত হওয়ার ঘটনা। রাজনৈতিক সৌজন্য-শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন মাত্রার বিপর্যয়। এর আগে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা সাধারণত প্রার্থীদের রেহাই দিত, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকত এবং এগুলো ঘটত সাধারণত নির্বাচনের দিনে এবং নির্বাচনী ফলাফলকে কেন্দ্র করে সাময়িক উত্তেজনায়। এবার এসব হামলা ঘটছে ধারাবাহিকভাবে।

এসব মামলা–হামলার কারণে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ থেকে বিএনপি দৃশ্যত গায়েব এবং মাঠ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া দখলে। বিএনপি যে এই নির্বাচনে আছে, অনেক এলাকায় তা টের পাওয়াই কঠিন। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমসুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। কমিশন এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনোরূপ কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও কমিশনের অগাধ ক্ষমতা, এমনকি প্রার্থিতা বাতিলেরও ক্ষমতা রয়েছে।

মহাজোটের বিজয়ের পারসেপশন সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরও যুক্ত হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের মনোনীতদের ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা বাতিল ও স্থগিতের বিষয়টি। এ পর্যন্ত আইনি জটিলতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না ২৩ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে ২১ জনই বিএনপির। বাকি দুজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮)। এ ছাড়া বর্তমানে ঐক্যফ্রন্টের ১৭ জন প্রার্থী জেলে রয়েছেন। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ গ্রেপ্তার অভিযান এখন পর্যন্ত চলছে।  

শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রত্যাশামতোই সবকিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের বলয়ে বিএনপি এতে অংশ নিচ্ছে—এবারের নির্বাচন বয়কট তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। তবে বিএনপিকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও আরেকটি একতরফা নির্বাচন করার মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষের জন্যই অত্যাবশ্যক ছিল। কাজেই নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য রাখা দুই পক্ষেরই দায়িত্ব। বিশেষ করে দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের।

আর এ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা অংশ নিতে পারলে এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনেও স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের গ্যারান্টি দেওয়া গেলেই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য হবে। তাদের অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সুযোগ সৃষ্টি হবে কারসাজির পরিবর্তে ‘উইল অব দ্য পিপল’ বা জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতার রদবদলের, যার ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সচল ও কার্যকর করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। তাই এই নির্বাচনের মাধ্যমে কোন জোট ক্ষমতায় গেল তা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার যথার্থতা ও কার্যকারিতা তথা নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদলের।

এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের কাছে আমাদের দাবি—তারা যেন আজ ৩০ ডিসেম্বর নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করে। নিশ্চিত করে প্রক্রিয়ার যথার্থতা ও কার্যকারিতার। একই সঙ্গে সব ভোটারের কাছেও আহ্বান—তাঁরা যেন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের উদ্যোগ নেন। এর মাধ্যমেই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথকে সুগম করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক