সুবর্ণচরের কালরাত

সুবর্ণচর! কী সুন্দর একটি নাম! কিন্তু আজ দুদিন হলো সুবর্ণচর নামটি আমার মনের চোখে আর সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা রূপে ধরা দিচ্ছে না; বরং ধরা দিচ্ছে এক বিভীষিকা হিসেবে। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাচ্ছি সুবর্ণচরের এক নিভৃত গ্রামের আঙিনায় এক নারীকে নেকড়ের মতো ঘিরে ধরেছে ১০-১২ জন পুরুষ, তারা অট্টহাসি হাসছে আর নারীটিকে ধর্ষণ করছে নিষ্ঠুর উল্লাসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মোবাইল ফোনে নারীটির ধর্ষিত, থেঁতলানো শরীরের ছবি তুলছে। ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে নারীটির স্বামী ও শিশুসন্তানদের। স্বামী আর্তচিৎকার করছেন তাঁর অসহায়ত্বে। কিন্তু তাঁর চিৎকার শুনতে পাবেন এমন কেউ নেই সেই তল্লাটে। সন্তানদের চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি, তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তারাও ছটফট করছে, বারবার বাবার কাছে প্রশ্ন করছে কী অন্যায় করেছেন তাদের মা? কখন মুক্তি মিলবে তাঁর? তাদের মা আদৌ কখনো ফিরতে পারবেন তো তাদের কাছে? তারা একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে। সেই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর জানা নেই বাবার। তিনি শুধু আর্তনাদ করে চলেছেন। অবোধ শিশুগুলো আর কিছুই চায় না; শুধু ফিরে পেতে চায় তাদের মাকে। তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায় মায়ের বুকে।

সুবর্ণচর নোয়াখালী জেলার একটি উপজেলার নাম। সুবর্ণচরে সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঠিক পরের রাতে গণধর্ষণ করা হয়েছে এক নারীকে। ‘গণধর্ষণ’ শব্দটির ভার এতটাই বেশি যে তা লিখতে গেলেও কেন জানি আঙুল সরতে চায় না, ভারী হয়ে আসে। কিন্তু সেই গণধর্ষণের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার গুরুভার সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে সুবর্ণচরের সেই নারীকে। তবে গত দুদিনে ধর্ষণের শিকার সেই নারীর আর্তনাদ নির্জন সুবর্ণচর ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে গোটা বাংলাদেশের মানুষের কানে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, নারীটির অপরাধ হলো তিনি ভোটকেন্দ্রে এলাকার প্রভাবশালীদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দেননি। তাই তাঁকে ভোটকেন্দ্রেই হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং সে রাতেই সেই হুমকিকে বাস্তবে পরিণত করা হয়েছে। গণধর্ষণের মাধ্যমে সেই নারীকে তাঁর ‘স্পর্ধা’র জন্য চরম শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। যেহেতু জানা গেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে এই জঘন্য ঘটনাটিতে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। অপরাধের গুরুত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের মারপ্যাঁচ। এরই মধ্যে অপরাধের ভয়াবহতা তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ঘটনাটি গুজব না বাস্তব, নির্বাচনের সঙ্গে এটির সম্পৃক্ততা আছে কি নেই, কিংবা অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সত্যতা আর অসত্যতার বিষয়টি। এই সব আলোচনার আড়ালে বরাবরের মতোই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আশ্রয়ে নেওয়ার বিষয়টি। কয়েকজন অপরাধীকে ইতিমধ্যেই ধরা হয়েছে। বাকিরা এখনো পলাতক। যারা ধরা পড়েছে, তারা আইনের আওতায় আসবে তো; নাকি প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় আইনের ফাঁক গলে বাইরে বেরিয়ে আসবে, তা সময়ই বলতে পারবে। তবে আমাদের সামনে নেই ভরসা করার মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন কোনো উদাহরণ।

সুবর্ণচরের নারীটি কি পাবেন তাঁর প্রতি হওয়া অন্যায়ের সুবিচার? বাংলাদেশ নাকি বিশ্বের বুকে বিস্ময় জাগানিয়া নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রায় দুই দশক ধরে নারী নেতৃত্বের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কদিন আগে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন ৬৮ জন নারীনেত্রী। তাঁরা কি কেউ সুবর্ণচরের নারীটির পাশে দাঁড়িয়েছেন? খোঁজখবর নিয়েছেন তাঁর? যে দেশে মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী, সেই দেশে নিজ ইচ্ছায় প্রার্থীকে ভোটদানের অপরাধে একজন নারীকে গণধর্ষণের শিকার হতে হয়। এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে! বাংলাদেশ কি দিন দিন ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে? যে দেশে বছরে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন, সে দেশ নারী ক্ষমতায়নের কথা গর্বভরে বলা যায় কি! এ তো গেল রিপোর্টকৃত ধর্ষণের পরিসংখ্যান। তবে এই সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি ঘটনা রয়ে যায় পর্দার অন্তরালে; যেহেতু ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনাই অপ্রকাশিত থাকে।

সুবর্ণচরে ধর্ষণের শিকার নারীটির শিশুসন্তানেরা তাদের মায়ের ওপর হওয়া অত্যাচারের বিচার চায়। তাদের নিষ্পাপ চোখগুলো কেন এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাক্ষী হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর চায় তারা। তারা জানতে চায়, এই নির্বাচন তাদের জীবনে কী পরিবর্তন নিয়ে এল। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি।

সুবর্ণচরের ঘটনাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাপুরুষদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে তা মেনে নিতে দ্বিধা কোথায়! একজন ধর্ষণকারীর সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে একজন ধর্ষক। অপরাধী কোনো দলের হতে পারে না, তার কোনো পরিচয় থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এই অপরাধীদের রাজনৈতিক দলগুলো বড় চাপ তৈরি না হলে কখনো ত্যাজ্য করে না। একজন খুনি কিংবা ধর্ষক একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শকে যে কতটা ভূলুণ্ঠিত করে, তা কি আদৌ ভেবে দেখে রাজনৈতিক দলগুলো! কোনো মুখোশের আড়ালে প্রকৃত অপরাধকে কখনো ঢাকা যায় না। যা সত্য তা দিবালোকের মতো প্রকাশ হবেই। আর জনতার আদালতে কোনো কিছুই অজানা থাকে না।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]