আজও দীপ্তিময় চট্টগ্রাম কলেজ

চট্টগ্রাম কলেজ
চট্টগ্রাম কলেজ

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও কাজেম আলী মাস্টারের স্মৃতিবিজড়িত বীর প্রসবিনী চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী-হালদাবিধৌত প্রাচ্যের রানি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম কলেজ। ঔপনিবেশিক শোষণ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রক্তস্নাত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়—এই তিনটি কালের সাক্ষী হয়ে গৌরবের সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করেছে হিরণ্ময় ঐতিহ্যের আধার এই বিদ্যাপীঠ।

১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিংয়ের শাসনামলে টমাস বেবিংটন মেকলকে সভাপতি করে গঠিত হয় জনশিক্ষা সাধারণ কমিটি। এই কমিটির সুপারিশে ১৮৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম জিলা স্কুল। ১৮৬৯ সালে পূর্বোক্ত জিলা স্কুলে এফএ (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক) ক্লাস চালুর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম কলেজ।

কিন্তু অর্থাভাবে এক বছরের মধ্যে কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে তৎকালীন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিব কবি নবীন চন্দ্র সেনের অনুরোধে মিরসরাইয়ের ধুম নিবাসী জমিদার রায়বাহাদুর গোলক চন্দ্র রায় ১০ হাজার টাকা অনুদান দিলে ১৮৭১ সালে পুনরায় কলেজটি চালু হয়। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন জে সি বোস। ১৯১০ সালে জিলা স্কুলকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়।

১৯২৪ সালে কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন। তাঁর সময়ে কলেজে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ কার্য সাধিত হয়—১. ছাত্রী ভর্তি কার্যক্রম অর্থাৎ সহশিক্ষা চালু, ২. কলেজবার্ষিকী প্রকাশ করা। পরবর্তী সময়ে এ কলেজের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা। যাঁদের মধ্যে অধ্যাপক রায়বাহাদুর পি ভি রুদ্র, অধ্যাপক আবু হেনা, ড. মো. এনামুল হক, এস এ আর মতিন উদ্দিন, অধ্যাপক আবু সুফিয়ান, অধ্যাপক রওশন আক্তার হানিফ, অধ্যাপক শেখর দস্তিদারের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এসব মহান শিক্ষাবিদের কার্যকালে একদিকে যেমন সম্পন্ন হয় কলেজের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যদিকে চরম উৎকর্ষে উন্নীত হয় শিক্ষার মান, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অপার অনুশীলন।

শুধু শিক্ষার বিস্তারে নয়, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের তীর্থকেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। ১৯২৬ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, ১৯২৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরু, ১৯৭০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ ক্যাম্পাসে আগমন ও বক্তৃতা করেন, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফেরদাউস খান দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অব টুডে: আ কম্পারেটিভ স্টাডি অব থ্রি স্ক্রিপ্টস নামক পুস্তক প্রকাশ করেন। কলেজের শিক্ষার্থী কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন, এজাহারুল হক, শামসুদ্দীন মো. ইসহাক, প্রতিভা মুৎসুদ্দি প্রমুখ চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন সমগ্র চট্টগ্রামে পরিচালিত হতো এই কলেজকে কেন্দ্র করে। ১৯৬২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতব্যাপী কলেজ ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় এই অঞ্চলের প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলেজের শিক্ষক পরিষদের সভা আহ্বান করে তৎকালীন অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ কলেজের প্যারেড মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং রাতে পরিবেশিত হয় বাংলা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ রচিত নাটক স্বাধীনতাসংগ্রাম। নাটক শেষে আবেগে উদ্দীপিত ১০ হাজার দর্শক সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে মিছিল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক অবনী মোহন দত্ত, ছাত্রনেতা মিয়া শাহজান কবির, মুরিদুল আলম, আবদুর রব প্রমুখ।

সার্ধশত বছরের পথচলায় বহু গুণী শিক্ষক শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম কলেজে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম বরেণ্য দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ইতিহাসবিদ এ ডব্লিউ মাহমুদ, ড. জনার্দন চক্রবর্তী, ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক মোতাহের হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক মোহর আলী, অধ্যাপক আবদার রশীদ, অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদ, অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদসহ আরও অনেকে।

কালপরম্পরায় কলেজের বহু মেধাবী শিক্ষার্থী ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, পাকিস্তান সরকারের সাবেক মন্ত্রী এ কে খান, সাহিত্যিক হাবীবুল্লাহ বাহার, বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মুতী, ড. এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, অধ্যাপক ড. আলমগীর মো. সিরাজুদ্দীন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রমুখ।

প্রকৃতির অপরূপ শোভামণ্ডিত বিস্তীর্ণ টিলাভূমির ওপর ২০ একর আয়তনের বিশাল ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য রেড বিল্ডিং, প্রশাসনিক ভবন, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উদ্ভিদবিজ্ঞান ভবন, পাঁচতলাবিশিষ্ট তিনটি একাডেমিক ভবন, ছাত্রছাত্রী মিলনায়তন, লক্ষাধিক মূল্যবান গ্রন্থসমৃদ্ধ লাইব্রেরি ভবন, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং সেন্টার, মনোরম বোটানিক্যাল গার্ডেন, অর্কিড হাউস, শহীদ মিনার, ’৫২ থেকে ’৭১ শীর্ষক ম্যুরাল, তিনটি ছাত্রাবাস, নবনির্মিত জননেত্রী শেখ হাসিনা হলসহ দুটি ছাত্রীনিবাস, দ্বিতল মসজিদ ভবন এবং প্যারেড ময়দানখ্যাত খেলার মাঠ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে স্নাতক (পাস), ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৮টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিসহ বর্তমানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ১৭ হাজারের অধিক।

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গীয় নবজাগরণের যে গান ধ্বনিত হয়েছিল এই কলেজে, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এই অঞ্চলের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তার বিস্তার ও সংকটে-সংগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজ সতত পালন করেছে উপযুক্ত ধাত্রীর ভূমিকা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও সবুজ ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের অবিরত ডাক দিয়ে যাচ্ছে ‘জ্ঞানলোকে বলীয়ান হয়ে সৎকর্মে নিয়োজিত হও, সৃজনে মুখরিত হয়ে ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হও’। সার্ধশতবর্ষে পদার্পণে কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি নিরন্তর শুভেচ্ছা।

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চট্টগ্রাম কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক