শ্রমিকের উন্নয়নটা কে দেখবে?

মাত্র কয়েক শ টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য রাস্তায় নামতে হলো শ্রমিকদের
মাত্র কয়েক শ টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য রাস্তায় নামতে হলো শ্রমিকদের

নতুন বছরের শুরুতে শিল্পমালিকেরা পেলেন কর-সুবিধায় আরও ছাড় আর নাছোড় শ্রমিকেরা পেলেন এক সুমনের গুলিবিদ্ধ লাশ।

বাংলাদেশের জিডিপি (৭.৮৬ %) নিয়ে ভারতও (৭.৩ %) হিংসা করবে। মাত্র পাঁচ বছরে বিশ্বের সুপার-ধনীদের মধ্যে ‘ফার্স্ট’ হওয়ার রেকর্ডে সুপারম্যানের দেশ আমেরিকাও লজ্জায় লাল। কিন্তু সবচেয়ে বিব্রতকর হলো পোশাকশ্রমিকদের আদেখলেপনা। কী নিদারুণ বৈপরীত্য। মাত্র কয়েক শ টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য জীবন দিয়ে তাঁরা আমাদের এত সব রেকর্ডের সুনামহানি করে দিচ্ছেন!

আন্দোলন হলেই মালিকেরা বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে শ্রমিকদের উসকানো হচ্ছে। কিন্তু আসল উসকানি তো বঞ্চনা থেকে আসে। মজুরির আন্দোলন চলছিলই, মাঝখানে পড়ল নির্বাচন-বিরতি। আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করে ২৫ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। চলতি মাস থেকে নতুন হারে মজুরি পাওয়ার কথা। সেটা ঠিকমতো না দেওয়াই তো আসল ষড়যন্ত্র।

২০১৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী ফি বছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বাড়ার কথা। কিন্তু তাতেও শুভংকরের ফাঁকি। ৫% হারে বাড়লে যাঁর এখন পাওয়ার কথা ৫,২০০ টাকা, তিনি পাচ্ছেন ৫,১৬০ টাকা। অর্থাৎ কমেছে ৪০ টাকা! যাঁর পাওয়া উচিত ৮,৯৩২ টাকা, তিনি পাচ্ছেন ৮,৫২০ টাকা। পুরো ৪১২ টাকা কম! তা ছাড়া, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডের অনেক শ্রমিকের বর্তমান বেতন আর বর্ধিত বেতন প্রায় একই। তার মানে আসলে বাড়েইনি। কত ভাগ কারখানা নিয়ম মেনে বেতন দেয়? এত আন্দোলন, এত কষ্ট, এত আলোচনা বিফলের ষড়যন্ত্রটা আসলে কার?

শ্রমিক ছাঁটাই, টার্গেটের চাপ বাড়ানো এবং নির্যাতন করে শ্রমিক উসকানো কি ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে? লোকসানে পড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হওয়ার হিসাব দিয়েছে বিজিএমইএ। এর দায় তো শ্রমিকের ছিল না। তাহলে তাঁরা বেকার হলেন কার ষড়যন্ত্রে? ঋণ-সুবিধা, এলসি-সুবিধা, কর-সুবিধার পরও কেন লোকসান হয়? নাকি আসলে চলে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপ এবং অতিমুনাফা? কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে ‘বেগমপাড়া’ গড়ে ওঠার পেছনের গল্পটা কি আমরা ভুলে যাব?

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে ‘কী করে বাঁচে শ্রমিক’ নামক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘৬১ শতাংশ শ্রমিক মনে করেন, তাঁর আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি।...অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা সামাল দেওয়ার জন্য শ্রমিকেরা নিয়মিত ঋণ নেন এবং খাদ্য ও বাসাভাড়া বাবদ ব্যয় কমিয়ে দেন। গড়ে একজন পোশাকশ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি মাসে গড়ে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেন। ফলে শ্রমিকেরা প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হন...আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং দেশি মালিকের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা কমিয়ে আনতে পারলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করা সম্ভব।’

মালিকদের যে ছাড় সরকার দিচ্ছে, তা জনগণের ভাগ থেকেই দিচ্ছে। এর ছিটেফোঁটা দিয়ে লাখো শ্রমিকের এবং তাঁদের সন্তানদের কল্যাণ সম্ভব। মজুরি বাড়ালে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব স্বীকার করেও বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দর-কষাকষির ব্যর্থতার দায়ভার কেন শ্রমিক একাই বইবেন? তা–ও আবার সেই শ্রমিক, যাঁর পুষ্টি গ্রহণের হার ২০১১ সালের চেয়ে কমে গেছে ২০১৬ সালের খানা জরিপে। আমাদের উন্নয়নে নগরে ভবন উঁচু হতে থাকে আর কমে যায় অপুষ্ট শ্রমিকের উচ্চতা। রাত-ভোরে যাঁরা রাস্তার পাশ ঘেঁষে চলেন, তাকিয়ে দেখবেন, তাঁদের ৯০ ভাগেরই উচ্চতা পাঁচ ফুটের দু-এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক। মেয়েদের উচ্চতা আরও কম। গ্রামের গরিব মানুষের অপুষ্টি আর দৈহিক অবিকাশের প্রমাণ এসব মানুষ। অভাব তাঁদের এমন বানিয়েছে, অভাবই তাঁদের ঠেলে নিয়ে এসেছে পোশাক কারখানায়। অভাবের আগুন থেকে বাঁচলেও তাঁরা মরছেন তাজরীনের আগুনে আর রানা প্লাজায় পিষে।

তারপরও বেড়েছে পোশাক রপ্তানির আয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এই সময়ে আয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে (প্রথম আলো, ৬ নভেম্বর, ২০১৮)। গত বছরের প্রথম ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি নজরুল হক। (প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)

ধনী হওয়ার রেকর্ডকে মাটি করে দেয় আয়বৈষম্য বাড়ার রেকর্ড। সোনার ডিমপাড়া হাঁসগুলোর কষ্টের রেকর্ডকে পরিহাস করে রপ্তানি আয়ের রেকর্ড। ৪০ বছর যাবৎ সোনার চামচের আদরে বড় করা পোশাক খাতের মুনাফাকে হিংসা করে শ্রমিকের বঞ্চনার রেকর্ড। মধ্য আয়ের দেশে, মেগা উন্নয়নের দেশে, বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের হাইওয়ে আর ফ্লাইওভারের দেশে, দ্রুত বর্ধনশীল ধনীদের দেশে ব্যবসায়ীরাই পান একাদশ জাতীয় সংসদের প্রায় ৬২ ভাগ আসন। আর শ্রমিক পাবেন শুধু গুলির ভাগ? প্রতিবছর টাকার দাম কমে আর চাল-ডাল-আটা-চিনির দাম বেড়ে মজুরিটাকে আরও করুণ করে তোলে। রাজধানী ও বড় শহরের জীবনযাত্রার ব্যয় যেখানে প্রায় নিউইয়র্কের মধ্যবিত্তের সমান, সেখানে শ্রমিকেরা চেয়ে আসছেন নিম্নতম মজুরি।

আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনকদের একজন ডেভিড রিকার্ডো। শ্রমিকের মজুরি সম্পর্কে তাঁর বিধি হলো, শ্রমিকদের মজুরি ততটাই হওয়া প্রয়োজন, যতটা না দিলে তাঁরা বাঁচতে ও শ্রম বিক্রি করতে পারবেন না। এখান থেকেই ‘বাঁচার মতো মজুরি’ কথাটা এসেছে। বাঁচার মতো মজুরিটাই কিন্তু ন্যায্য মজুরি না। বাঁচার মতো মজুরি হলো সেটাই, যা না হলে প্রাণীর মতো করেও প্রাণ ধারণ করা যায় না। আর ন্যায্য মজুরি হলো তাই, যা পেলে শ্রমিক সপরিবারে মানুষের মতো বাঁচতে পারেন। ধনী ও গরিবের বাঁচা সমান নয়, কারণ উভয়ের চাহিদা এক নয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা যে নিম্নতম মজুরির দাবি তুলেছেন, তা দিয়েও মানুষের মতো বাঁচা সম্ভব নয়।

অথচ সরকারের যাবতীয় অর্জনের ভিত তাঁরাই গড়ে দেন। ৪০ লাখ শ্রমিকের ঘামে ভেজা বৈদেশিক মুদ্রার জোরেই সরকার ‘উন্নয়নের’ গর্বটা করতে পারে। এত এত গণমাধ্যম উন্নয়নের এই সুফলটা না পারে শ্রমিকদের বোঝাতে, না পারে মালিকপক্ষকে মানাতে। দোষ দেব কাকে? সরকারের ও মন্ত্রিসভায় ব্যবসায়ীরাই বেশি। রাষ্ট্রপক্ষ আর মুনাফাপক্ষ প্রায় মিলে গেছে। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মালিকদের মুনাফার হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খুঁটি। অনেক উদ্যোক্তার সংগ্রামেরও ফসল। এটা আমাদের জাতীয় সক্ষমতা। এ খাত টিকলে আমরা টিকব। মানবিকতা বা করুণার খাতিরে না, নিজেদের স্বার্থেই এই খাতটাকে স্থিতিশীল করা দরকার। পোশাকমালিকদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা সুবিচারের পক্ষে। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের বেতন বাড়লে সেই টাকা বিদেশে পাচার হবে না, বিদেশের বাজারেও খরচ হবে না। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা যেসব পণ্য কিনবেন, বিদ্যুতের বিল দেবেন, ভ্যাট দেবেন, তাতে চাঙা থাকবে দেশীয় অর্থনীতি। সচ্ছল শ্রমিক শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান পরিবার দিয়ে বাড়াবে উৎপাদনশীলতা। আমেরিকা দাসপ্রথাকে বোঝা মনে করেছিল বলেই এত এগিয়েছে। আমরা দেশে বা বিদেশে শুধু শ্রম না বেচে, যদি উন্নত শ্রমিক দিয়ে উন্নত শিল্প অর্থনীতি গড়তে পারি, তাহলেই কেবল স্বাধীনতার স্বপ্নটা সত্যি হবে। দাসশ্রমের ম্যানেজারির চেয়ে সেটা অনেক মর্যাদার ও শান্তির। এটা না করাই পোশাক খাতের কাঠামোগত ষড়যন্ত্র; যার দায় শ্রমিকের নয়।

মধ্যম আয়ের দেশের বিজ্ঞাপনে বছরের শুরুতেই শ্রমিকের রক্তের যে দাগ লাগল; তা শুভ হলো না।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]