মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে?

জামিনের যত ফেরকা আছে, তার মধ্যে আগাম জামিন সবচেয়ে কঠিন। কারণ, এটা আইনে নেই। তদুপরি এ অঞ্চলের প্রতিটি সুপ্রিম কোর্ট একমত যে অসাধারণ পরিস্থিতিতে বিরল ক্ষেত্রে এটা মঞ্জুরযোগ্য। ২০০৯ সালে ৩৮ সেকেন্ডে একটি জামিনের ঘটনার তদন্ত করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। অবশ্য প্রতিকার হয়নি। গত মাসে দুই দিনে ৫৫৮টি আগাম জামিন দেওয়া হয়েছে। এ সবই বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উদাহরণ।
গতকাল বৃহস্পতিবার ২০ নম্বর বিচারকক্ষের সামনে নোটিশ দেখি, ‘নতুন কোনো মোশন জমা নেওয়া হবে না।’ এ কথার মানে, এখানে আর আগাম জামিনের জন্য নতুন দরখাস্ত নেওয়া হবে না। গত মাসে এখানে আগাম জামিনের ঝড় বয়ে গেছে। ওই নোটিশ হলো ঝড়ের চিহ্ন।
বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চই হলো এনেক্স ভবনের ২০ নম্বর বিচারকক্ষ। ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ওই বেঞ্চের কার্যতালিকায় ৭১৮টি আগাম জামিন আবেদন মুদ্রিত ছিল। এর মধ্যে আসামির সংখ্যা এক হাজারের বেশি হতে পারে। এবং তাঁদের সবার আদালতকক্ষে হাজির থাকার কথা। তার মানে, ওটা একটা গণ-আত্মসমর্পণেরও দৃশ্য। এদিন ওই বেঞ্চ ৩০৭টি মামলায় আগাম জামিন দিয়েছেন। কমপক্ষে ৪০০ আসামি জামিন পেয়েছেন।
হাইকোর্টে জামিন-ঝড় এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তবে প্রশ্ন, যে প্রতিকার সমক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি বেঞ্চ দিতে পারেন, তা আইনজীবীরা কেন একটি বিশেষ আদালতের কাছ থেকে নিতে ছোটেন? এর উত্তর আমরা কার কাছ থেকে পাব? এর কি জবাবদিহি থাকবে না? বার ও বেঞ্চ তো নীরবই থাকবেন।
২৯ জানুয়ারি ওই একই আদালতের কার্যতালিকায় ৪১১টি আগাম জামিন অবেদন ছাপা হয়। আবেদন মঞ্জুর হয় ২৫১টি। এখানেও অন্তত ৩০০ আসামি আগাম জামিন পান। এঁরা বিচিত্র অপরাধের আসামি। কেউ কেউ দুর্ধর্ষও হতে পারেন। তবে তাঁরা কে কোন ধরনের আসামি, তা আপনি সহজে বুঝতে পারবেন না। নিয়ম হলো, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে আবেদনকারীরা একটি কপি আগেই জমা দেন। তবে সেখানেও সুষ্ঠু তদারকি ও শৃঙ্খলা নেই। মামলা ব্যবস্থাপনায় একটি নৈরাজ্য চলছে। ওই দুই দিনে আইন কর্মকর্তাদের অসহায় অবস্থায় দেখা গেছে। অবশ্য জামিনপ্রার্থীদের শয়ে শয়ে আইনজীবী ও জামিন প্রদানে উন্মুখ আদালতের সেই পরিবেশে রাষ্ট্রের আইনজীবী আন্তরিক হলেও নিজকে তাঁদের খড়ের কুটো ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না।
প্রতি মিনিটে যদি একটি আদেশ পাস হয়, তাহলে সেখানে কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা এক কথায় আসলে কিছুই ঠাহর করা সম্ভব হয় না।
আমি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের কাছে যাই। বলি, আদালত এক দিনে ৭১৮টি মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন, এই আশ্চর্য কথা কীভাবে সুপ্রিম কোর্ট ছাপাতে পারে? তিনি জানালেন, কোন দিন কতটি মামলা কার্যতালিকায় আসবে, সে বিষয়ে রেজিস্ট্রারের দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা সম্পূর্ণরূপে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের অধিকার।
২০১০ সালের ৬ জুন রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া পিন্টু মামলায় আপিল বিভাগ একটি উল্লেখযোগ্য রায় দেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাতে লিখেছিলেন, ‘এফআইআরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাঁকে আগাম জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি রাজনৈতিক নেতা কি নেতা নন, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।’
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে সন্দেহভাজন। তাঁর আগাম জামিন লাভে ওই নীতির ব্যত্যয় দেখলাম। দুদকের এফআইআরে উল্লেখ আছে, খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী বিলকিস হোসেন ইংল্যান্ডের নিকটবর্তী দ্বীপ রাষ্ট্র গের্নসিতে একটি যৌথ ব্যাংক হিসাবে স্থায়ী জামানত হিসেবে আট লাখ চার হাজার ১৪২ পাউন্ড জমা রেখেছেন। ২০০৮ সালে ওই টাকার হদিস বের করেছিলেন লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী। আওয়ামী লীগ ও দুদক পাঁচ বছর ঘুমানোর পর সম্প্রতি একটি মামলা করেছে। ওই টাকা জব্দ অবস্থায় রয়েছে। এমনকি তা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত বলেও আদালতের সামনে তথ্য ছিল। মওদুদ আহমদ এবং বিএনপির ডাকসাইটে আইনজীবীরা মোশাররফের জন্য আগাম জামিন পেতে ওই ২০ নম্বর কক্ষে দাঁড়ালেন। গের্নসি সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। জাতিসংঘের এতগুলো রাষ্ট্র থাকতে মোশাররফ দম্পতি কেন আটলান্টিকের বুকে ইংলিশ চ্যানেল দ্বীপে টাকা রাখতে গেলেন, তার ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। মোশাররফ তা দেননি, বিএনপিও নয়।
বেইলি উইক অব গের্নসির মুখ্যমন্ত্রী পিটার হারুদ ২৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেছেন। কারণ, তিনি তাঁর ‘সুনামের প্রতি ঝুঁকি’ অনুভব করেছেন। তিনি চ্যানেল আইল্যান্ড স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ছিলেন। পরিচালকের অতীত ভূমিকা সম্পর্কে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাই ‘অযথা মিডিয়ার মনোযোগ’ এড়াতে পদত্যাগ করেছেন। মোশাররফের দেখা পেলে পিটারকে হয়তো পদত্যাগ করতে হতো না। কারণ, তিনি আগাম জামিনের পরামর্শ পেতেন!
আইনের শর্ত হচ্ছে, আগাম জামিন দিতে হলে কারণ লিখতে হবে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, খন্দকার মোশাররফের জামিনাদেশে কোনো কারণ লেখা নেই। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ অবশ্য ওই আদেশ বাতিল করেছেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত ওই একই বেঞ্চ আদেশে লিখেছেন, উভয় পক্ষকে শোনা হয়েছে। এফআইআর দেখা হয়েছে। অতঃপর প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে যে বিষয়টি অভিযুক্তের পক্ষে গেছে। তাই এই আদালতে তাঁর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করলাম। ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর।
বিচারব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে তার আরও উদাহরণ দিই। একই আদালতে আরেকটি নির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয় হল-মার্ক কেলেঙ্কারি খ্যাত তানভীর মাহমুদের স্ত্রী জেসমিন ইসলামের বিরুদ্ধে। জেসমিন বর্ধিত সময়ের মধ্যেও সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে ব্যর্থ হন। জেসমিনও আগাম জামিন পান এবং আপিল বিভাগ তা বাতিল করেন। অথচ এসব জামিন একান্তই নিম্ন আদালতের এখতিয়ার। প্রকৃতপক্ষে জামিন পুলিশি সিদ্ধান্তের বিষয়। আর বাংলাদেশে জামিন নিয়েই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট ভারাক্রান্ত থাকে।
অনিয়ম কাকে বলে দেখুন। ১৯ জানুয়ারি মোশাররফ এবং ১০ ফেব্রুয়ারি জেসমিনকে দেওয়া আগাম জামিন মঞ্জুরের আদেশ একই ভাষায় একই ছকে লেখা। দুই আদেশের প্রতিটির প্যারাগ্রাফ একই বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে। দুই আদেশে আক্ষরিক অর্থেই কেবল নাম-ধাম ও তথ্যগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এভাবে একটা বিচারব্যবস্থা চলতে পারে কি না। সর্বোচ্চ আদালত এর প্রতিকার দিতে অসমর্থ কিংবা শোচনীয়ভাবে অসফল।
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘২৭০ মিনিটে ২৪০টি মামলায় জামিন দেওয়া কি সঠিক হয়েছে?’ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি তদন্ত প্রতিবেদন (প্রতি ৩৮ সেকেন্ডে একটি জামিন) প্রকাশ করেছিলাম।
তদন্তে দুই বিচারকের স্বাক্ষরবিহীন ২৭২টি জামিনাদেশ বেরোল। এমনকি ৩৫টি নথির হদিস মিলল না। ২০০৯ সালের ২৩ ও ২৪ নভেম্বর বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই গণজামিন দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুজন বিচারকের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসের প্রথম অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই তদন্তের নথি আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তদন্তের সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাফাজ্জল ইসলাম। তিনি অল্প সময় ছিলেন। ওই নথিটি তিনি প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিমের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। এরপর নথিটি প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের হাতে পড়ার কথা। আমাকে
বলা হয়েছে, চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি নথিটি উদ্ধার করতে পারেননি। তার চেয়েও বড় কথা, পত্রিকায় (প্রথম আলোয়) কেন গণজামিন দেওয়া-সংক্রান্ত খবরের সঙ্গে বিচারকদের ছবি ছাপা হয়েছিল, সেটাই নাকি বড় হয়ে ওঠে। কথিতমতে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সে কারণে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্ত হন।
জামিন ব্যক্তি স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু গণজামিন একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর উভয়ে উদ্যোগী ও সদা সক্রিয় থাকলে এর রাশ কিছুটা টানা সম্ভব। তবে এর উত্তরও পেতে হবে যে গণজামিন না দিলে কী হতো? সারা দেশের ভুক্তভোগীরা কেন ভেঙে পড়ছে ঢাকায়?
একেবারে ভেঙেচুরে পড়া থেকে এ ধরনের ব্যবস্থাই হয়তো বাঁচিয়ে রাখছে। কিন্তু কত দিন? পুলিশি ভয়ের শাসনের প্রবর্তকেরাই এ নৈরাজ্যের জন্য দায়ী। কেবল বিচারব্যবস্থা নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে পচন ধরেছে, সেটা স্বীকার না করলে এ থেকে বেরোনো যাবে না।
আগামী কিস্তি: ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের স্বাধীনতা

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]