লোকসভায় বিতর্কিত বিল পাস

গত বুধবার ভারত সরকার লোকসভায় যে নাগরিকত্ব বিল পাস করেছে, সেটি যেমন বৈষম্যমূলক, তেমনি বিভেদাত্মক। অন্য কোনো দেশে বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে নাগরিক অধিকার দিতে গিয়ে তারা নিজ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বিতর্কিত এই বিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে মুসলিম ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের যেসব নাগরিক ২০১৪ সালের আগে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে অমুসলিম শরণার্থীর তালিকায় রাখা হয়েছে।

ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে এই বিল পাসের উদ্যোগ নেয়। সে সময় বিরোধী দলের সদস্যদের প্রবল আপত্তির মুখে বিলটি স্থগিত করা হয়। বিজেপিবিরোধী প্রায় সব দল এবারও বিলের বিরোধিতা করে। কিন্তু সংসদে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিলটি পাস করতে কোনো সমস্যা হয়নি। লোকসভায় বিল পাস হলেই আইনে পরিণত হবে না। আইনে পরিণত করতে হলে রাজ্যসভায়ও পাস হতে হবে।  

নাগরিকত্ব বিলের বিষয়ে আমাদের আপত্তি হলো এর দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হলেও উভয় পক্ষ এই বাস্তবতা মেনে নেয় যে ধর্ম-নির্বিশেষে যেকোনো নাগরিক তার পছন্দসই দেশে থাকতে পারবে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ভারতে এবং হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যায়। ভারত বরাবর নিজেকে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে দাবি করে আসছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হোক না কেন, তারা দেশটির সংবিধানের মৌল চেতনাবিরোধী কোনো আইন পাস করতে পারে না।

ভারতের নাগরিকত্ব আইনে যে তিনটি দেশ থেকে যাওয়া অমুসলিমকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে অন্য দেশ থেকে আসা মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও এর পেছনে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিই কাজ করেছে।  

বিশ্বায়নের যুগে নানা কারণেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষ যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর পেছনে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় কারণও থাকতে পারে। কিন্তু লোকসভায় গৃহীত বিলে অন্য সব কারণ বাদ দিয়ে ধর্মীয় বিষয়টিই সামনে নিয়ে আসা দুর্ভাগ্যজনক। তদুপরি ধর্মীয় কারণে যদি কোনো নাগরিক আরেক দেশে যেতে বাধ্য হয়, তারও প্রতিকার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে করা উচিত নয়। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আদনান সামি পাকিস্তান থেকে ভারতে গেছেন এবং নাগরিকত্বও পেয়েছেন। আর এ কথা মনে করারও কারণ নেই যে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেই শুধু মানুষ ভারতে যায়; ভারত থেকেও প্রতিবেশী দেশে গিয়ে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে, এ রকম উদাহরণও কম নয়।

এমনিতেই ভারতে সংখ্যালঘুরা নানা বৈষম্যের শিকার। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের স্বার্থবিরোধী অনেক আইন ও ফরমান জারি হয়েছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস হলে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে এ আইনকে কেন্দ্র করে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেড়েছে। লোকসভায় বিল পাসের পর আসামের জোট সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আসাম গণপরিষদ। তাদের আহূত হরতালে জনজীবন অচল হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি সরকার এই বিল পাসের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। কিন্তু সেই সুবিধা গোটা ভারতে বিপদ ডেকে আনে কি না, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়। আমাদের প্রত্যাশা, ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এ রকম একটি বৈষম্যমূলক বিল কোনোভাবেই আইনে পরিণত হতে দেবে না।