সুশাসনের পথে বড় বাধা মোসাহেবি

বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘চামচা’ শব্দটির অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। চামচার অর্থ দেওয়া হয়েছে তোষামোদকারী, মোসাহেব, চেলা। এই ধ্বনাত্মক শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফারসি ‘চম্‌চহ্‌’ শব্দ থেকে এসেছে। পশ্চিমা দেশে রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের পর থেকে মোসাহেবি বা চামচামি উঠে গেছে। আমাদের দেশে অশোক ও চন্দ্রগুপ্তের সময় যেমন ছিল, সুলতানি ও মোগল আমলে তো ছিলই। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে যে ছিল, তার প্রমাণ রেখে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মোসাহেবের যে বৈশিষ্ট্য তিনি বর্ণনা করে গেছেন, তার ওপরে কোনো কথা হয় না। সে জন্যেই তিনি বাঙালির জাতীয় কবি। তাঁর লেখনীতে: 

সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’

মোসাহেব বলে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে!

হুজুরের মতে অমত কার?’

...      ...     ...   ...

সাহেব কহেন, ‘কি বলছিলাম,

গোলমালে গেল গুলায়ে!’

মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।

দিব কি হস্ত বুলায়ে?’

[সাহেব ও মোসাহেব] 

অনেক দিন ধরে বঙ্গীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান চামচামি বা মোসাহেবি। যে নেতা যত ক্ষমতাধর, তাঁর চামচার সংখ্যা তত বেশি। বরং বলা ভালো, চামচার সংখ্যা বেশি বলেই তিনি বড় নেতা। সামন্ততন্ত্রে মোসাহেব থাকা স্বাভাবিক, গণতন্ত্রে মোসাহেবির কোনো স্থান নেই। তবে ক্লাসিক্যাল মোসাহেবির সঙ্গে আধুনিক চামচামির মৌলিক পার্থক্য হলো, সেকালে তোষামোদকারী সাহেবের মনোরঞ্জন করত তাঁর সামনাসামনি, এখন চামচামি করা হয় দেয়ালে চাররঙা পোস্টারে, ডিজিটাল ব্যানারে এবং পত্রিকার বিজ্ঞাপনে। কেউ সাংসদ হয়েছেন, চালাও চামচামি। তারপর তিনি ইয়ে হয়েছেন, চালাও ডাবল চামচামি।

আগে আউলচাঁদেরমতাবলম্বীদের বলা হতো কর্তাভজা। এখন সেই ধর্মীয় সম্প্রদায় বিলুপ্ত। এখন ক্ষমতাধর কর্তাদের তোষামোদকারীদের বলা হয় কর্তাভজা ওরফে চামচা। চামচামি হলো কৃত্রিম প্রশংসা। তবে কেউ বলতে পারেন, প্রশংসার আবার কৃত্রিম–অকৃত্রিম কী? প্রশংসা প্রশংসাই। না, বাংলাদেশে প্রশংসা দুই প্রকার।

চামচামির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। যোগ্যতা ছাড়া চাকরি পাওয়া যায়। পদ না থাকলেও প্রমোশন পাওয়া যায়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো যায়। মেয়াদ যত শেষ হয়ে আসবে, চামচামির মাত্রা তত বাড়বে। মুখের চামচামিতে কাজ না–ও হতে পারে, চামচামির একটি নতুন শাখা হয়েছে—পত্রিকায় কলাম লেখা। ঘরের মধ্যে নয়, দেশের মানুষকে সাক্ষী রেখে চামচামি। মৌখিক চামচামির দাম কী, মোসাহেবির যদি রেকর্ডই না থাকল, তার মূল্য কী? টেন্ডার পেতে চামচামি এবং কাজ না করে বিল ওঠানোর জন্য আরও বেশি দরকার। যে গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে মনোনয়ন–বাণিজ্য হয়, সেখানে মোসাহেবির ভূমিকা থাকবে না, তা ভাবাই যায় না।

যিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য, তাঁকে আমাদের সমাজে মানুষ চিরকালই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। ত্যাগ, সততা, মিতব্যয়িতা ও সরল জীবনযাপনের জন্য উপমহাদেশের সমাজ একজনকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে, লোকদেখানো শ্রদ্ধা নয়। শ্রদ্ধা করে এই জন্য যে শ্রদ্ধাই তাঁর প্রাপ্য।

অতি উঁচু পদে অধিষ্ঠিত একজন যখন প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা না ভোগ করে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেন, তাঁকে মানুষ দ্বিগুণ শ্রদ্ধা করে। মহাত্মা গান্ধী বা মাওলানা ভাসানীকে যেমন করে, উপমহাদেশে তেমন মানুষ ও জননেতা অতীতে অনেকেই ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের তিনজন গান্ধীবাদী মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল ঘোষ ও প্রফুল্ল সেন একেবারেই সাধারণ মানুষের মতো আমৃত্যু জীবনযাপন করেছেন। মৃত্যুর সময় কেউ ছিলেন অভাবগ্রস্ত।

গান্ধীজি যদি মাত্র এক দিন রেলগাড়ির তৃতীয় শ্রেণির কামরায় ভ্রমণ করতেন, তা হলে তাঁকে মানুষ বলত ‘ভণ্ড’। কোনো দেশের কোনো নবনিযুক্ত মন্ত্রী এক দিন বাসে বা কারও মোটরসাইকেলের পেছনে বসে হেলমেট ছাড়া অফিসে গেলে তাঁর প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে প্রচ্ছন্ন চামচামি নেই, তা বলা যায় না। আমরা উচ্চকণ্ঠে সম্মিলিতভাবে প্রশংসা করব তাঁকেই, যিনি পাজেরোতে না গিয়ে সাধারণ যাত্রীবাহী বাসে অফিসে যাতায়াত করেন।

দুর্নীতির সঙ্গে চামচামির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দুর্নীতির পূর্ব ধাপ মোসাহেবি। আগে চামচামি ছিল ব্যক্তিগত ব্যাপার, এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। একজন সাংসদ, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলে, তাঁকে তাঁর মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রাণঢালা অভিনন্দন, ফুলেল শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জ্ঞাপনে কার্পণ্য করছেন না। এর নামই প্রাতিষ্ঠানিক মোসাহেবি। সব মানুষ যেমন মোসাহেব নয়, সবাই চামচামি পছন্দ করেন না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ মোসাহেবি অপছন্দ করেন। ব্যক্তিত্বহীনদের পুঁজিই মোসাহেবি। যেসব কর্মকর্তা সৎ, দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তাঁরা মোসাহেবি পছন্দ করেন না। ওই না কারাটা তাঁদের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে। সাহেবের অন্যায্য অনুরোধ না রাখলে তাঁকে অসম্মান ও তিরস্কার করা হয়। তাঁদের থেকে রাষ্ট্র কোনো উপকার পায় না। রাষ্ট্র থেকে সুশাসন নির্বাসিত হয়।

একটি সরকার কী প্রক্রিয়ায় গঠিত হলো, সে এক প্রশ্ন, কিন্তু গঠিত সেই সরকার কতটা সুশাসন দিতে পারে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রে জনগণের মতামত ও সমর্থনের মূল্য বেশি, মেকি গণতন্ত্রে মোসাহেবির প্রাধান্য। যখন কেউ শপথ নিয়ে উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত হন, তাঁর নৈতিক দায়িত্ব অশেষ। তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ; তোষামোদকারীদের কাছে নয়। তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ক্যাডার বাহিনী, তোষামোদকারী ও চেলাচামুন্ডার দরকার আছে। তবে তারাই সব, জনগণ বাদ পড়ে যায়, তাহলে সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

প্রশংসা আসবে জনগণ থেকে, চামচাদের থেকে নয়। ভালোবাসবে জনগণ, চাটুকারেরা করবে পদলেহন। কেউ উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হলে অভিনন্দন তাঁর প্রাপ্য। দেয়াল, ইলেকট্রিকের খাম্বা, সড়কদ্বীপ, পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ভালোবাসার প্রকাশ, তা প্রকৃতপক্ষে চামচামিরই বহিঃপ্রকাশ। যে অর্থ খরচা হয় এই প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ভালোবাসা নিবেদনে, তার শত গুণ উশুল হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলে অত বোকা বাঙালি নয় যে টাকাও ঢালবে, প্রাণও ঢালবে। বস্তুত বর্তমানে সুশাসনের পথে বড় বাধা মোসাহেবি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক ও গবেষক